আমার বাড়ির সামনে সুব্রতদের বাড়ি। বাড়িটা দর্মার বেড়া দেওয়া, টিনের চালের সঙ্গে লোহার তার টানা দিয়ে বাঁধা, যাতে ঝড়ঝাপটা এলে টিনের চাল উড়ে পালাতে না পারে...
আমাদের পাড়াতে যখন ইলেক্ট্রিসিটি আসে তখন আমি ক্লাস টুয়েলভে পড়ি। টিভি আসে অনেক পরে। আমাদের পাড়াতে প্রথম টিভি আসে সুব্রতদের বাড়ি। সুব্রতর মায়ের টিভি দেখার খুব শখ। আমাদের পাড়াতে যখন ভিডিও হল চলত, সুব্রতর মা ভিডিও হলের মান্থলি টিকিট কাটত... মাসের একটা দিনও ভিডিও হলে সিনেমা দেখা মিস করত না... মনে পড়ে আমিও একদিন ভিডিও হলে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম... 'শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ'... একটা গুন্ডাকে কাঁচা ডিম খাইয়ে পেটে ঘুসি মেরে মুরগির বাচ্চা বের করেছিল প্রসেঞ্জিত.....
সুব্রতর মা খুবই কুচুটে টাইপের লোক। কখনও সখনও টিভি দেখতে চাইলে টিভি দেখতে দিত না। বলত গরমে টিভি চালালে টিভি গরম হয়ে যাবে। খুব গরম হলে টিভি নষ্ট হয়ে যাবে। আমি নিরুপায় হয়ে টিভি না দেখে বাড়ি চলে আসতাম। মায়ের সঙ্গে আলোচনা করতাম সুব্রতর মা আমাদের পাড়ার কুটনি নাম্বার ওয়ান।
ধীরেধীরে বড় হলাম। সুব্রতর মায়ের প্রতি আমার রাগ ক্রমেক্রমে বাড়তে থাকল... ওই একই কারণ টিভি দেখতে চাইলেই বলত টিভি গরম হয়ে যাবে.... আমি সুযোগ খুঁজতাম.... এমন একটা দিন আসুক, যেদিন আমি এর প্রতিশোধ নেবো।।।।
কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি.... একদিন রাত্রে হঠাত সুব্রতর প্রচন্ড জ্বর হলো। অসহ্য যন্ত্রণায় বিছানাতে ছটফট করতে লাগল। দাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হল... কাটোয়া থেকে বর্ধমান মেডিকেল কলেজ... সেখান থেকে কলকাতা.....
জাপানিজ এনকেফ্যালাইটিস। সুভাষ কাকা ট্রেনে হকারি করে। সংসার মোটামুটি চলে যায়। কিন্তু এরকম একটা পরিবারে কোনও মারাত্মক অসুস্থতা ঢুকলে, গোটা পরিবারটা শেষ হয়ে যায়। প্রত্যেকটা দিন সুভাষ কাকা হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে এলাকার আশেপাশের স্কুল গুলোতে যেত কিছু সাহায্যের আশায়। খুব কষ্ট হত দেখে... মনেমনে ভগবানের কাছে একটাই প্রার্থনা করতাম... ভগবান অভাব অনটন সব দাও... কিন্তু কোনও গরীব মানুষকে অসুস্থতা দিওনা...
সুব্রত বেঁচে গিয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে মারা যায়নি। গোটা পরিবারটা পথে বসে গিয়েছিল। সুব্রত হাঁটতে পারেনা... অসুস্থতার পর প্রায় পাঁচ বছর কেটে গিয়েছে, এখনও হাতের পাশে দুটো লাঠি একটু একটু করে এগিয়ে যায়... দু'পা হাঁটার পর আছাড় খেয়ে পড়ে যায়... খুব জোরে শব্দ হয়... মনে হয় আশেপাশে কোনও পৃথিবী ভেঙে পড়ল। হাত-পা কেটে রক্ত ঝরে...
সুভাষ কাকা এখনও ট্রেনে আঙুর বেচে। সুব্রতদের এখনও সেই দর্মার বেড়া... এখনও টিনের চাল লোহার তার দিয়ে বাঁধা যেন ঝড় দিলে না উড়ে যায়...
সুব্রত এখনো ব্যায়াম শেখে। ওর ব্যায়াম কাকা রোজ এক-দুই গুনে হাতটা, পা'টা একটু করে তোলে আর যাওয়ার সময় তিরিশ টাকা নিয়ে যায়... জানিনা... সবাই হয়তো আশায় আছে... একদিন সুব্রত হাঁটতে পারবে... সঠিকভাবে হাঁটতে পারবে... হাঁটার সময় ধপ করে পড়ে গিয়ে শরীর দিয়ে রক্ত বেরোবে না...
সুব্রত সারাদিন বাড়িতে থাকে। বিকেলের দিকে নির্মলের মুরগির দোকানে গিয়ে বসে। মাঝেমধ্যে আমি যখন বাড়ি ফিরি, আমার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে 'সুদীপ.... একটু নিয়ে যাবি'।
আমি যে সুব্রতকে সঠিকভাবে নিয়ে আসতে পারি তা মোটেই নয়। বরং ওর ওই স্থূল শরীরের ভারে আমিই ভেঙে পরি... তবু ওর একটু অবলম্বনের প্রয়োজন... শুধুমাত্র কারও কাঁধ ধরে একটু এগিয়ে যাওয়া....
মানুষের সময়ের বড্ড অভাব.... আমি আজ সুব্রতর কথা লিখছি সেটাও ওই অভাবের সময় থেকেই একটু সময় চুরি করা.... কারণ দিনের শেষে প্রত্যেকটা মানুষকে ঈশ্বরের কাছে কনফেস করতে হয়। আজ সত্যিই ব্যস্ততা ছিল... বাড়ি ফেরার সময় সুব্রতর দিকে তাকাইনি.... ওকে বলার সুযোগ দিইনি... 'একটু বাড়িতে এগিয়ে দিবি'.... আমাদের সমাজে মানবিক মূল্যবোধের কোনও ভ্যালু নেই... আর থাকলে সুব্রতকে আমার দিকে এইভাবে চেয়ে থাকতে হতনা... সুব্রতকে এগিয়ে দিতে হবে বলে অনেকেই বিকল্প রাস্তায় হাঁটে.... পরিবারের কাউকেও সেইভাবে ওর প্রতি দায়িত্ববোধ পালন করতে দেখিনা... হয়তো সুব্রত আজ লিভিং সোসাইটির ননলিভিং থিং অথবা পারিবারিক বোঝা..... জানিনা... আজ ফেরার সময় আছাড় খেয়েছে কিনা... ভূমিটা কিছুক্ষণের জন্য কেঁপে উঠেছে কিনা.... হাত-পা কেটে রক্ত বেরিয়েছে কিনা.....।
0 Comments
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন