বসন্তে তখন গ্রীষ্মের ছোঁয়া.. চারিদিকে রোদের চাঁদরে সবকিছু হলুদ হয়ে রয়েছে.. আমার পাশের সিটে বসে থাকা মেয়েটি ঘুমের ঘোরে আমার গায়ে ঢলে পড়ছে.. তার লম্বা কোঁকড়ানো কালো চুল আমার নাকে বারবার সুড়সুড়ি দিয়ে আমার ঘুম ভাঙাচ্ছে... এই সময় দুজনের একটা সেল্ফি নিলে বন্ধুদের কাছে 'আমারও গার্লফ্রেন্ড আছে' প্রমাণ করতে খুব বেশি সমস্যায় পড়তে হতনা..ভগবান 'কুবুদ্ধি' একবার আমার মাথায় ভর করলেন... ইচ্ছে হল স্বেচ্ছায় একবার তার ঘাড়ে ঢলে পড়ে তার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে... কোনরকমে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলাম... আমার 'হরে কৃষ্ণ'র রিপ্লাই এসেছে... না! না! ফেসবুকে আমার তিলক কাটা ছবি থাকলেও মোটেই আমি সাধু না.. তবু প্রত্যেকদিনের কথোপকথনের শুরুতে আমি সবাইকে 'হরে কৃষ্ণ' পাঠাই.. এতে যা পুণ্য হয় তা ফিক্সড ডিপোজিট করে রাখি যাতে বুড়ো বয়সে ধর্মের ভয়তে আমাকে ভীত না হতে হয়... খুব মারাত্মক অভিযোগ।... আসলে দোষটা আমারই। ধরো তোমার বান্ধবি যে তোমাকে শুধুমাত্র বন্ধু মনে করে, তাকে তোমার চ্যাট হিস্ট্রি পড়তে দিয়েছ...তোমার সাথে যার চ্যাট হিস্ট্রি সে পড়ছে তাকে তুমি তোমার চ্যাট হিস্ট্রি পাঠরত বান্ধবীকে 'গার্লফ্রেন্ড' বলে উল্লেখ করেছ.. মানে তোমার বান্ধবী যে তোমাকে শুধুমাত্র বন্ধু মনে করে তাকে তোমার গার্লফ্রেন্ড বানিয়েছ... কী অদ্ভুত ব্যাপার... এক ইংরেজি আরেক বাংলা শব্দের ক্যামন আকাশ পাতাল তরিতফাত! সে যাইহোক! এবার তোমার বান্ধবী যদি তোমায় জিজ্ঞেস করে কেন তুমি তাকে অন্যের কাছে 'গার্লফ্রেন্ড' বলেছ?.. এর কী কোনও উত্তর তোমার কাছে আছে? বাসটা ছুটছে.... কখনও গোলাপি রঙের ওড়না আবার কখনও কালো কোঁকড়ানো চুল কপাল, গাল, আর আমার ঠোঁটের সঙ্গে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলছে... আমার মা মাঝেমধ্যে বলে শাস্ত্রে নাকি লেখা আছে ঘুমন্ত মানুষকে জাগাতে নেই... আর এত মেয়ে!... আমার থেকে বছর দুয়েকের ছোট... আমার মতই রোগা... হাতের কবজির বাঁধনটা ঠিকঠাক না, তুলনামূলক সরু ... আমার মতই ঘড়ি পরলে হয়তো তাকেও মানাইনা.... নাকি ঘড়ি পরলে আমাকে মানাইনা এটা আমার অন্ধবিশ্বাস!.. এখন এসব উত্তর খুঁজতে যাওয়ার সময় নয়...। মেয়েটার ফোন এল... সম্ভবত কোনও ব্যাঙ্ক থেকে ফোন করেছে... নিজেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে এনে কথা বলতে শুরু করলো... 'দিলকিস খান'। আমার নামটা খুব পছন্দ হয়েছে... কোনও মেয়ের নামেই যদি 'দিল' থাকে... তারপরে আবার 'কিস'...আমার মেনুতে আর কী চাই! আমি তো স্বল্পাহারী... আমি অত্যন্ত ব্যস্ত মানুষ.. কারও প্রতি আমার কোনও খারাপ অভিপ্রায় নেই; সেটা বোঝাতে আমি আমার মোবাইলে মেইল চেক করতে শুরু করলাম.. ইংরেজি খবরের কাগজটা মুখের সামনে ধরলাম.. নাকের সামনে দুটো আঙুল জড়ো করে খুব ভাবুক আর ইন্টেলেকচুয়াল ভঙ্গিতে ত্রিপুরার ইলেকশনের খবর পড়তে শুরু করলাম... তুমি বাসে যাচ্ছো... কেউ তোমার জন্য অপেক্ষা করছে... তুমি জানোনা তুমি কখন তার কাছে পৌঁছবে... এটাও জানো না আদতে কোনওদিন পৌঁছতে পারবে কিনা! তোমার রাস্তায় অসংখ্য বাঁক... ধুলোবালি... নোংরা... এইসব নিয়ে তুমি নিজেই ভীত সন্ত্রস্ত... এরপরেও কী তুমি কাউকে তোমার জন্য অপেক্ষা করে রাখতে পারো?... মিথ্যা প্রতিশ্রুতির থেকে কঠোর বাস্তবের মুখোমুখি হওয়া কী শ্রেয় নয়! আচ্ছা! তোমার বাবার নাম কী? দাদুর নাম? দাদুর বাবার নাম? তাঁর বাবার নাম.... তোমাকে জীবনের সবকিছু মনে রাখার প্রয়োজন নেই... বরং কিছু জিনিস ভুলে যাওয়াই অধীকতর ভাল... তাই কখনও সখনও কোনও প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায়না...আবার কখনও কোনও প্রশ্ন করা যায়না.. কখনও তুমি কাওকে হারাতে ভয় পাও.. কখনও তাকে চাইতে ভয় পাও.. কখনও ঘৃণা করতে ভয় পাও.. কখনও ভালবাসতে ভয় পাও.... আর কখনো জীবনে তুমি এমন কোনও সময়ের সম্মুখীন হও যখন যেকোনো কিছুই ভয়ের... তুমি সময়ের দিকে তাকাও.. আর অপেক্ষা করো কখন তা পার হয়ে যায়.... আমার হাত ঘড়ির বেল্টের ঘাঁট এক ঘর কমিয়ে নিলাম... আমার হাত ঘড়িটা এতক্ষণ দেওয়াল ঘড়ির মত দেখাচ্ছিল... দিলকিস সেটা কী লক্ষ্য করেছে? নাহ্! দিলকিসকে 'হরে কৃষ্ণ' বলা হয়নি.. সালাম ও জানানো হয়নি.. ওর নামটা ফেসবুকের সার্চবারে রেখে এন্টার বাটনটাও প্রেস করিনি এখনও... শুধু মনে হয়েছে আমার ঘড়িটার সময় তিন বছর এগিয়ে দিয়ে একটু টাইম ট্রাভেল করতে... আমি কোথায় দাঁড়িয়ে আছি! তখনও কী কারও জন্য অপেক্ষা করছি... নাকি কেউ আমার জন্য অপেক্ষা করছে!... অথবা প্রেমের সমস্ত রহস্য ভেদ করে আমাদের এই অপেক্ষার পরিসমাপ্তি ঘটেছে....