ধরুন আপনি মাসের শেষে জামাকাপড় কেঁচে সেগুলো দড়িতে মেলছেন। হঠাত দেখলেন, ও প্রান্ত থেকে দড়িটা ছিঁড়ে আপনার সমস্ত জামাকাপড় মাটিতে পড়ে গেল। কেমন লাগবে আপনার?

বাবা যেদিন আমার প্রথম অর্জিত আয়ের  টেপরেকর্ডারটা আমার সামনে ভেঙে ফেলেছিল, এর চেয়েও ঢের বেশি খারাপ লেগেছিল আমার।

তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। মা স্কুল যাওয়ার জন্য প্রায়শই দু-একটাকা দিত, আমি দেড়টাকা দিয়ে একটা মাটির ভাঁড় কিনেছিলাম পয়সা জমানোর জন্য। আমি না প্রায়শই স্বপ্ন দেখতাম একটা ছোট্ট চারকোণা ওয়াকম্যান কিনে তাতে কালো রঙের কমদামী একটা হেডফোন গুঁজে গান শুনছি। স্বপ্নটা যেই ভেঙে যেত, হঠাত একগাদা মন খারাপ মনে জমা হত, ঈশ! স্বপ্নটা যদি আরও কিছুক্ষণ থাকত, আমি আরও কয়েকটা গান শুনতে পারতাম!

কোনও নতুন জিনিস যখন আমার হাতে পড়ে আমি তার শেষ না দেখে ছাড়িনা। এই যেমন নতুন মোবাইল বা ক্যামেরা কিনলে এই বয়সেও আমার এইরকম ঘটে।
তো একদিন মাটির ভাঁড়টা ভেঙে ফেললাম, তারপর দুইশ টাকা দিয়ে কিনেই ফেললাম একটা 'ওয়াকম্যান'।
প্রথম দুতিনদিন একবারও হাত থেকে নামিয়েছি বলে মনে পড়ছে না। 'লাঠি' 'ভালবাসা ভালবাসা' সিনেমার গান শুনতাম।

একদিন দুপুরবেলাতে খেতে বসেছি, বাঁহাতে ওয়াকম্যান বাজছে, বাবাও খাচ্ছে। বাবা আমার এই বেয়াদবি সহ্য করতে না পেরে ওয়াকম্যানটা হাতে তুলে শানের মেঝেতে আছাড় মারল। চারকোণা ফিতে লাগানো 'ক্যাসেট' টা খুলে পড়ে যেতে দেখেছিলাম চোখের সামনে। মনে হচ্ছিল, ওগুলো যেন একটা মানুষের নাড়ীভুঁড়ি, যে আমার সামনে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে, জীবনের শেষবারের জন্য বাঁচার চেষ্টা করছে। আমি আর ওকে বাঁচাতে পারিনি।

তারপর থেকে তিনদিক আমি না খেয়ে ছিলাম। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে একলা কাঁদতাম ধানের জমির আলে বসে। সেই কান্না কেউ দেখেনি। বাড়ির অনেকে আমার শোকাতুর অবস্থা অনুধাবন করত হয়ত।

তারপর একদিক মেনে নিলাম। সহজ শর্তেই মেনে নিয়েছিলাম জীবনের কোনও কিছুই চিরস্থায়ী নয় যেটা আমায় চিরসুখী করতে পারে। এখন কোনও কিছুতেই আর ততটা দুঃখ পাইনা। শুধু প্রত্যেকটা হতাশা, ব্যর্থতা আর ছেড়ে যাওয়ার পর একটা কথাই ভাবি.......ভগবান যা করেন, মঙ্গলের জন্যই করেন।

Sudip Sen
চব্বিশে নভেম্বর।