জীবনে কখনও প্রেমপত্র লিখিনি, তার একটা বড় কারণ হতে পারে আমার হাতের লেখা খারাপ... ক্লাস টু-থ্রী'তে মা পড়াত, তারপর একদিন মায়ের থেকেও বড় হয়ে গেলাম... আকার, আয়তন আর উচ্চতায়...

মা যখন প্রথমপ্রথম লাল-কালো নটরাজ রুল পেন্সিলে লেখা শেখাত, বারবার বলত গোটাগোটা অক্ষরে লিখতে... হাতের লেখা বইএর মত হওয়া চাই...। 

আমার লাইন কিছুতেই সোজা হয়না। লেখার লাইন তো দূরের কথা, সদ্য আবিষ্কার করলাম আমি নিজেও কিছুটা ব্যাকা... তাই সমান্তরাল সরলরেখা সর্বদা বক্র করে ফেলতাম...  সত্যিই তাই... এইভাবে ক্যামন যেন জীবন টাকেও বেঁকিয়ে ফেলেছি... প্রেমার্থে লাইন...!  সেতো আরও জটিল....

একদিন মা পড়তে বসিয়েছে। বই দেখেদেখে লিখতে হবে। আমি যতবার মন দিয়ে লেখার চেষ্টা করি, মা ততবার মুছে আরও সুন্দরভাবে লিখতে বলে। মা পড়াতে বসানোর জন্য আলাদা কোনও সময় পেত না। দেখা যেত ভাতের উনুনে তালপাতার পাখা দিয়ে হাওয়া করে আঁচ ওঠানোর চেষ্টা করছে, আর এদিকে আমি লিখছি...

সেদিন ভাত রান্না হয়ে গেছে... মা তাৎক্ষণিক কোনও কাজে বাড়ির বাইরে গেছে...  আমি বারবার চেষ্টা করেও যখন মায়ের মন মত লিখতে ব্যর্থ হলাম, বইটাই ছিঁড়ে ফেললাম। ভাতের আঠা বইএর পৃষ্ঠার পিছনে লাগিয়ে সেটা খাতাই আটকে রাখলাম... মায়ের বিরুদ্ধে অসন্তোষ বা বিদ্রোহ ঘোষণা করার এর থেকে বড় কোনো উপায়  সেদিন খুঁজে পাইনি।

তারপর দেখতে দেখতে একদিন বি.এ পাস করে ফেললাম। বার কয়েক মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে দেখলাম মায়ের থেকেও বড় হয়ে গিয়েছি। ধীরেধীরে বুঝলাম  মা অনেক বোকা... অনেক সময় বোকাবোকা কথা বলে, অনেক ছোটখাটো কারণে সাময়িক উত্তেজিত হয়ে পড়ে। মায়ের প্রতি অত্যন্ত রেগে গেলে এমনও মনে হত যে মা ঠিকঠাক কথা বলতেও জানেনা।

একসময় মাথা ঠান্ডা করার চেষ্টা করি। আমার মা আসলে অনেক কিছুই জানে... হঠাত করে কোনও আত্মীয় বাড়িতে এলে তাকে খেতে বলতে জানে, দু-তিন মিনিটের পরিচয়েও অপরিচিত কাউকে আত্মীয় বানিয়ে ফেলতে পারে, আমি যখন হাজার হাজার নৌ-মাইল ব্যর্থতার সমুদ্রে সাঁতরে পার হবার পর যখন দেখি চারিদিকে শুধুমাত্র শূন্যতা.... মা মৃদু হেসে বলে আবার চেষ্টা করো... শ্রম কখনও বিফলে যায়না। মাঝেমধ্যে এই ভেবেই আমার চারিদিকে সন্তুষ্টির চাদর ছড়িয়ে দিই... আমার মত পরান্নভোজী প্রাণিকে মা এখনও সহ্য করছে কীভাবে!  মায়ের বিরুদ্ধে জমতে থাকা অভিযোগের মেঘগুলো জমাট বেধে তখন বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে পড়ে... কখনও চোখ বেয়ে...

এই একদম না.. প্লিজ... মোটেই বৃষ্টি না কিন্তু... খাটের স্ট্যান্ডে রাখা চারটে জিন্স আজ বড্ড কষ্ট করে মা কেচে দিয়েছে... না শুকোলে মুশকিলে পড়ে যাব....