ট্রেনে চেপে বাড়ি ফিরছি... আমার বাঁদিকে একজন ষাটোর্ধ বৃদ্ধ মানুষ, নীল রঙের একটি শান্তিনিকেতনী ব্যাগ কাধে নিয়ে বসে আছেন... ব্যাগের উপরের চেনটা কাটা... একটা সেফটি-পিন দিয়ে দুদিকের দুটো মুখ একসঙ্গে জোড়া লাগান...

ফোনের চার্জ নয় শতাংশ। নোটিফিকেশন এল.এ.ডির লাল আলোটা জ্বলছে...  ভদ্রলোক কৌতূহলী দৃষ্টিতে কয়েকবার দেখে জিজ্ঞেস করলেন...

- আগুন নেগে গিয়েচে?
আমি উত্তর দেওয়ার জন্য কিছুক্ষণ সময় নিলাম... তারপর বললাম...  না.. না... এমনিই আলো জ্বলে....

আবার কিছুক্ষণ মন দিয়ে আলোটা পরীক্ষা নিরীক্ষা করলেন... তারপর জিজ্ঞেস করলেন...

- ঠাকুর আছে? ধূপ দিয়েচ?
এবার হাসব না কাঁদব ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না... কিছুক্ষণ পর সাধ্যমত বোঝানোর চেষ্টা করলাম... উনি উত্তরে সন্তুষ্ট হননি বুঝতে পারলাম...  তারপর গল্প জমানো শুরু করলাম...... ছ'টাকা দিয়ে দুজনের জন্য দু'কাপ লিকার চা কিনলাম....

ভদ্রলোক একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক স্কুলশিক্ষক... আমাদের এই স্মার্ট-ওয়ার্ল্ডের অনেক দূরে উনার বাস... সেকেন্ডের মধ্যে আমি যে উনার বাড়ির আশপাশের রাস্তা  বলে দিতে পারি, তা উনার কল্পনার বাইরে... আমি জি.পি.এস খুলে গুগল ম্যাপ চেক করতেই উনি বললেন: 'দেখত বাবা ভাদুরি দাক্তারের পুকুরটা কোথায় দেখাচ্ছে কিনা!'

সহজ সরল সাদামাটা লোকজন আমি খুব পছন্দ করি... তাদের সঙ্গে কথা বলতেও খুব ভাল লাগে... এইতো আজই ট্রেনে ওঠার আগে, একজন অসাধারণ শিক্ষকের সঙ্গে পরিচয় হল... আগে স্কুলে পড়াতেন এখন অবসরের দুপুরবেলা গুলো কিছুতেই যেন কাটতে চায়না, তাই বাড়িতে ছাত্রছাত্রী নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন... কী অসাধারণ একজন ব্যক্তিত্বের অধিকারী! অত্যন্ত নম্র-ভদ্র এবং বিনয়ী.... ইনাদের মত মানুষজনের আশেপাশে থাকতে ভাল লাগে, অন্তত বায়বীয় অক্সিজেন, কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাধ্যমে যদি কিছু সৎগুণ নিজে অর্জন করতে পারি তার লোভে...। ইনাদের ফেসবুক প্রয়োজন হয়নি, হোয়াটসঅ্যাপ ছাড়াই এতটা কাল কাটিয়ে দিয়েছেন! ভাবতেও অবাক লাগে........

আমরা জটিল যৌবনের দূত... তাই প্রায়শই সারল্যের জয়গান করতে পছন্দ করি... অনেকসময় কি চাই? কি প্রয়োজন তার থেকেও মনে হয় একবার অঙ্ক করে দেখি.... কি আছে!... যা পেয়েছি তা দিয়ে কতটা নিজের প্রয়োজন মেটাতে পেরেছি!

বাসে ওঠার পর মনে হচ্ছিল মোবাইলটা আনলক করি, ফেসবুক.. হোয়াটসঅ্যাপ.. মেসেঞ্জার...  কত বন্ধু! কিন্তু যতবার স্ক্রিনটা স্লাইড আপ করি...  নতুন কিছু কি পেয়েছি? আমি যেমন সময়ের অপচয় এড়াতে কাউকে টুংটাং করে দুটো মেসেজ করছি...নিজের সময় কাটাচ্ছি...  অনেকেই তো তাই... যোগাযোগের প্রকৃত গুরুত্বটা কোথায়? মেসেজিং কেন করি আমরা....?? অপ্রয়োজনীয় কথোপকথন? হাই! হ্যালো! খেয়েছ! ঘুমিয়েছ! ব্যাস!

এই কারণে এখন আর টেক্সটিং টা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়না... প্রয়োজন হলে কাউকে কল করে নিই...  সেখানে যোগাযোগের গুরুত্ব থাকে... দায়সারা ভাবে সেরে দেওয়া যায়না....

ভেবেছিলাম পাহাড় সম্পর্কে রচনা লিখব... আমি এখন নদীর মোহনাতে আটকে পড়েছি....