অনেক কষ্টেসৃষ্টে খুচরো চারটাকা জোগাড় করলাম। জীবনের ছোটখাটো সঞ্চয় না শিখতে পারলে, খুব বেশি সাশ্রয় করা যায়না। একটু সহজভাবে বলি, আমার গন্তব্যস্থলের বাসের ভাড়া চোদ্দ টাকা, তবে ভাঙানি বারো টাকা দিলেও কন্ডাকটরের সঙ্গে খুব বেশি কথা কাটাকাটি করতে হয়না।
বাসে উঠেই বিপদ! ঠিকভাবে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই এক চরম ঝাঁকুনিতে আমি প্রায় পড়ে যাব এমন অবস্থা... আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল একটি মেয়ে, দেখে কলেজে পড়ে বলেই মনে হল... সে তার চোখ নিয়ে দৃঢ়ভাবে আমার দিকে তাকাল...
এবিষয়ে কোনও রিসার্চ আমি করিনি। তাসত্ত্বেও আমার মনে হয় দেশের নিরানব্বই শতাংশ মেয়ে মনে করে বাসে কোনও মেয়ে দেখলেই ছেলেরা ইচ্ছে করে তাদের গায়ে পড়ে... তাদের কোমল ত্বকীয় স্পর্শে ছেলেদের জীবন ধন্য হয়... কিংবা সব পুরুষের মধ্যেই একটা বন্য ব্যাপার থাকে, নারী শরীরের স্পর্শ পেতে মুখিয়ে থাকে... সুযোগ পেলেই তার পূর্ণকামের প্রকাশ ঘটে... একটু পিছনটা অথবা সামনেটা ছুঁয়ে নেয়...। ঠিক এই কারণে আমি মেয়েদের থেকে সর্বদা দূরত্ব বজায় রাখি....
বাসে জায়গা পাওয়া গেল... বসলাম। সিটের ধারে একটি বৌ বসে চুন আর খৈনি ডলছে, আমি ঠিক তার ডানপাশে... এখানে 'বৌ' শব্দটির ব্যবহার অত্যন্ত যথোপযুক্ত। সাধারণত শিক্ষিত, আত্মনির্ভরশীল এবং ধনী সম্প্রদায়ভুক্ত মহিলাদের 'ভদ্রমহিলা' বলা হয়, এবং অশিক্ষিত, গরীব মহিলারা 'বৌ'। যিনি আমার পাশে বসে আছেন, তিনি অবশ্যই আত্মনির্ভরশীল কিন্তু বাকি শনাক্তকরণ বৈশিষ্ট্যগুলি না মেলার কারণে তিনি একটি 'বৌ'। ভদ্রমহিলা হতে হলে চলাফেরা ও বেশভূষার রীতিনীতি জানতে হয়।
বৌটার পাশে একটি নোংরা ব্যাগ। দেখে মনে হচ্ছে বাজারে কচুর লতি অথবা কল্মি শাক বেচতে গিয়েছিল। অনবরত চুন আর খৈনি ডলছে। জানালা দিয়ে বাসের ভিতরে হাওয়া ঢুকলেই সেই হাওয়ার সঙ্গে চুন-খৈনি আমার চোখে এসে ঢুকছে। খৈনির ঝাঁজে বেশ কয়েকবার কাশি হল... কিছু বলতেও পারছিনা। আসলে বলি
না.. খুব বেশি অসুবিধা নাহলে আমি কাউকেই কিছু বলিনা....
তারপর একসময় আবিষ্কার করলাম বৌটা একা না, ওর সামনের সিটে যে বাচ্চা ছেলেটা বসে আছে, ওটা ওরই...চুপচাপ বসে বসে মোটু-পাতলু খাচ্ছে, বয়স আর কত হবে! ওই বছর আটেকের মত...
সাধারণত এই টাইপের বৌয়ের পাশে আমি বসিনা। ক্যামন একটা ঘেন্না লাগে। এটা খুব খারাপ শোনায়, তবুও... সত্যিটা সত্যি....
বাচ্চাটা হঠাত সামনের সিট থেকে উঠে ওর মায়ের কোলে এসে বসল। আমার গা ঘিনঘিন আরও বাড়তে থাকল... একেই গরম, তার উপর খৈনির অত্যাচার, তার মধ্যে দুজনের সিটে তিনজন... উফ্ফ্!
এবার বলি চারটাকা কীভাবে জোগাড় করলাম। একটা দশটাকার নোট ভাঙিয়ে তিনটে ক্লরমিন্ট আর তিনটে পাল্স নিলেই ব্যাস! সহজ হিসেব... বাসের সময় টুকুতে আরামসে কেটে যাবে লজেন্স চিবোতে চিবোতে... একটা পাল্স মুখে ভরলাম...
তারপর একসময় মনে হল পাশে একটি বাচ্চা ছেলে বসে আছে, ওকে না দিয়ে আর কীভাবে খাই! ওকেও দিলাম....
এইবার আমাদের আলাপ শুরু হল.... ছেলেটিকে দেখে মনে হবে ওই যারা রাস্তায় রাস্তায় খেলা দেখায়, পাথর বাজিয়ে গান করে, দড়ির উপরে হাটে তাদের মত। কিন্তু ওর মধ্যে একটা বিশিষ্টতা আছে.... ও খুব ভাল ভাষা আয়ত্ত করতে পারে...
যেমন বাংলা বলছে, তেমন হিন্দি আর ততটাই ভাল ইংরেজি... আমি ওর মাকে জিজ্ঞেস করলাম বাংলা, হিন্দি সহজ কিন্তু ইংলিশ কীভাবে শিখল...?
আগে কার্টুন চ্যানেলগুলো হিন্দিতে ছিল, এখন ইংলিশে... ওই দেখে দেখে....
ব্যাপারটা আমার কাছে অতটা সহজ মনে হয়নি। তারপর জিজ্ঞেস করলাম স্কুল যায়না কেন? ওর মা বললো বাড়িতে একা থাকতে পারেনা, তাই সক্কাল বেলাতেই ওকে বাজারে নিয়ে যায়, তাতে ওর মায়েরও কাজে ও সাহায্য করতে পারে....
ব্যাপারটা আমি ভাবছিলাম। অনেকক্ষণ ভাবছিলাম। কেন আমরা পিছিয়ে আছি, কেন আমার দেশ পিছিয়ে আছি, আর আমি তো অনেকটাই পিছিয়ে..... ভাবতে ভাবতে বাস স্ট্যান্ডে বাস থেমে গেল... সকলেই নেমে পড়লাম...
তারপর পাশের দোকান থেকে ওকে একটা স্লেট, কয়েকটা পেনসিল, একটা কমদামী প্লাস্টিকের বই আর একটা কুরকুরের প্যাকেট কিনে দিলাম...
ওর মাকে বারবার স্কুলে পাঠানোর জন্য অনুরোধ করলাম, এটুকুই তো করতে পারি... স্বাধীন দেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে এটুকুতো আমি করতেই পারি.. তাই না??
না... নিজেকে সৎ বা মহৎ প্রমাণ করার মত কোনও দায় আমার নেই... আমি যেমন, তেমনই... তবুও যদি একটা কাল্পনিক গল্প কাউকে ভাবাতে পারে, একটু সময় অপচয় করে লিখতে আমার আর আপত্তি কোথায়????
Sudip Sen
5th June 16
0 Comments
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন