দু'হাজার সাত... বর্ষাকাল... আমি তখন ক্লাস টেন' এ...
অনবরত বৃষ্টি নেমেছে, ছাড়াছাড়ির কোনও বালাই নেই। মেঘের গর্জন আর অনবরত বিদ্যুতের ঝলকানি... এর মধ্যেই বাবা আর কয়েকজন লোক দরকারি কাজে দুঃসম্পর্কের এক মাসির বাড়িতে গেল...
এমনিতেই পড়াশোনা করতাম না... আর বৃষ্টির দিনে তো বালাইষাট, পড়াশোনারর নামই করতে নেই। সারাদিন বিছানার এদিকওদিক, একেক সময় বাচ্চা ছেলের নত হাতটা মুঠো করে কানের কাছে ধরতাম... ধরতাম আর ছাড়তাম... বৃষ্টির নানারকম শব্দ শুনতে পেতাম... বেশ ভাল লাগত...
সন্ধেবেলা চারিদিকে ব্যাঙের ডাকে কানে ঝালাপালা ধরে যেত... সেদিন সন্ধের খবরটা এতটা অপ্রত্যাশিত হবে ভাবতে পারিনি... ফোনে বাবার আতঙ্কিত গলার আওয়াজ, বাবা এইভাবে কখনও কথা বলেনি... আমি শুনছিলাম....
বাবা যে গাড়িতে (সুমো) ফিরছিল, সেটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাশের ধানের জমিতে পড়ে গিয়েছে। দু'জনকে সঙ্গেসঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, বাবার ঘাড়ে চোট লেগেছে, হাতের কব্জির অবস্থাও খারাপ....
আমি শুনে একদম থতমত খেয়ে গিয়েছি । এর আগে আমার বা ভায়ের শরীর খারাপ হয়েছে, বাবা অথবা মা'ই তার দেখভাল করেছে... আর আজ বাবারই এমন দুর্ঘটনা, আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না কি করব! মা'কে বললে মা সেই কান্নাকাটি শুরু করে দেবে... ভাইও ছোট... সাংঘাতিক খারাপ অবস্থা বাড়িতে....
তারপর আরেকটা ফোন পেলাম... বাবার ফোন.. যতদ্রুত সম্ভব এখান থেকে একটা গাড়ি নিয়ে বাবার কাছে যেতে হবে... আমি একটু শক্ত হলাম...
অনেক সময় আমরা ভাবি আমাদের জীবনে বন্ধুদের অস্তিত্ব শুধুমাত্র সিগারেটের কাউন্টার ভাগ করে নেওয়ার জন্য। কিন্তু না... আমি তৎক্ষণাৎ কয়েকটা বন্ধুকে ফোন করলাম....তারপর সবাই মিলে একটা ট্যাক্সি জোগাড় করলাম... আর রওনা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম....
আরেকটা ফোন এল... বাবার... বাবা গাড়ি নিয়ে গড়াগাছা (বাড়ির থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে) চলে এসেছে... কোনও ভ্যান বা রিক্সা কিচ্ছু পাওয়া যাচ্ছেনা, তাই আমাকে সাইকেল নিয়ে বাবাকে বাড়ি নিয়ে আসতে হবে... বাবা ট্যাক্সি নিতে বারণ করল...
আমি আর একটা বন্ধু সাইকেল নিয়ে গড়াগাছা গেলাম... বাবা একটা ক্লাবে বসেছিল, চারিদিক অনেক লোকের ভিড়.... তারপর ধীরেধীরে বাবা আমার কাছে এল, (অনেকে সাইকেলে চাপতে নিষেধ করেছিল)... তারপর জিজ্ঞেস করল....
- আমাকে নিয়ে চালাতে পারবি?
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম.....
- হুঁ...
ধীরেধীরে সাইকেল চালিয়ে আমরা বাড়ি ফিরছিলাম। বাঁশবাগান, বন, ব্যাঙের ডাক সবকিছু পেরিয়ে... সেসময় আমার অনেককিছু মনে হচ্ছিল... মনে হচ্ছিল আমি বড় হয়ে গিয়েছি, বাবার দায়িত্ব নিতে শিখেছি, মাকে না জানিয়ে ঠান্ডা মাথায় সমস্যার সমাধান করতে পারছি... অনেক রকমের জটিল অনুভূতি....
বাড়ি ফিরে দেখি অনেক লোক জড় হয়েছে, বস্তুত বাবার দুর্ঘটনার কথা সকলে জেনে গিয়েছে... বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল, পরের দিন এক্সরে করতে বলা হল, কিছু ওষুধপাতি দেওয়া হল...
বাকি দুজনের অবস্থা বাবার থেকেও খারাপ, তাদের পরিবারকে জানানো হল...
সেই রাতটাতে আমি ঠিকঠাক ঘুমোতে পারিনি... কেন জানিনা... আমি কি ভাবছিলাম তাও জানিনা... প্রত্যেক মিনিটে একটাই রিমাইন্ডার আমার মাথায় ঘোরাফেরা করছিল... আমি বড় হয়ে গিয়েছি....
0 Comments
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন