কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি, ফার্স্ট ইয়ারের রেজাল্ট মারাত্মক খারাপ হওয়াতে রাতের ঘুম ছুটে গিয়েছিল... সাধারণত বিছানাতে পড়তে বসলে প্রচণ্ড ঘুম এসে যেত, তাই ঘরের মেঝেতে পড়তে বসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
আমি ছোট থেকেই 'সকাল সকাল ঘুমানো আর সকাল সকাল জাগা'তে বিশ্বাসী ছিলাম... এমনকি এখনও তাই... রাত ন'টা তে এত ঘুম পেত যেন মনে হত আমি আর পৃথিবীতে নেই.. কলেজে যদিও এগারোটা পর্যন্ত বাড়িয়েছিলাম তাও আবার কিছু 'রাত জাগার' কৌশল আবিষ্কারের মাধ্যমে... হাতের কাছে অম্রুতাঞ্জন আর টোস্ট বিস্কুট (ইটের মত শক্ত) রাখতাম। খুব ঘুম পেলেই চোখের উপর দিয়ে অম্রুতাঞ্জন বুলিয়ে নিতাম... তাতে কিছুটা যন্ত্রণা হত, চোখের জলও বেরোত কিন্তু ঘুম ছেড়ে যেত। তারপর টোস্ট বিস্কুটে কামড় দিতাম....
এইভাবে কিছুক্ষণ কাটানোর পর আবার ঘুম পেলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়তাম... তারপরেও ঘুম আসলে বই নিয়ে পায়চারি করতাম... না.. না.. আমি মোটেই ভাল ছাত্র ছিলাম না, তবে নিজের কাজটা ঠিকঠাক করার চেষ্টা করতাম।
পৃথিবীর সবাই দেখতে সুন্দর হবে এমন কোনও সিস্টেম এই ধরাধামে নেই... তবে হ্যাঁ... নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখার চেষ্টা সবাই করতে পারে.. নিজেকে সুন্দর দেখানো একটা শিল্প, কোনও আর্টিফিশিয়াল মেক আপ ছাড়াও নিজেকে সুন্দর দেখানো যায়.... তবে সেই যাদুকাঠির সন্ধান সকলে পায় না... আমাদের কলেজে একটি মেয়ে পড়ত, ওর কথা বলাতে জড়তা ছিল... অথচ দেখতাম রোজ লাইব্রেরি গিয়ে সমস্ত বই ঝেড়ে পরিষ্কার করছে। একটা সাদা রুমাল দিয়ে চেয়ার, টেবিল, ডেস্ক মুছছে। কোনও আর্থিক সহায়তার বিনিময়ে ও এসব করত না... এমনিই করত... ভালোবেসে... ও সুন্দর... প্রকৃতির আপন খেয়ালেই ও সুন্দর...
কলেজে পড়ার সময় আমার মুখের চোয়াল বসা ছিল। কোনও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া যেমন বলতে শোনা যায় বিড়ি খেয়ে মুখের চোয়াল বসিয়ে ফেলেছে... অনেকটা সেরকম ব্যাপার.... আমি কোনওদিন বিড়ি খাইনি, সিগারেট অ্যালকোহলিক বেভ্যারিজ তো নৈব নৈবচ... এই একটা কারণেই হয়তো কোনও মেয়ে আমাকে পছন্দ করতে পারে বলে আমার ধারণা ছিল।
এতটাই রোগাপাতলা ছিলাম যে ঝড় দিলেই উড়ে যাব এমন অবস্থা। শার্ট বা টিশার্ট কোনওটাতেই আমাকে মানাতো না। জিন্স পরলে পিছনদিকটা মনে হত ফ্ল্যাট টিভি...উপর নীচ বরাবর গাঙ্গেয় অববাহিকার সমতলভূমি। শরীরের তুলনায় মাথাটা বড় ছিল... সেই অর্থে আমাকে মাথামোটা বলা যেতে পারে.....
পৃথিবীর সবথেকে সহজ অথবা কঠিন কাজ নিজেকে চেনা... নিজেকে জানা.. নিজেকে বোঝা.... সেই স্কুল লেভেল থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম আমার দ্বারা প্রেম ট্রেম হবেনা... তাই ওদিকের চিন্তা ভাবনা ছেড়ে দিয়েছিলাম... আর তাছাড়াও আমার প্রতি কে ইম্প্রেশড হবে? কী দিয়ে আমি তার মনকে প্রভাবিত করব? এত সব ভাবার থেকে লেডি ম্যাকবেথের ক্যারেক্টার, সমন্যামবিউলিজম্ মুখস্থ করা অধিকতর শ্রেয় বলে আমি মনে করতাম...
সেসময় একটা প্রশ্ন আমার মনে প্রায়ই ঘোরাফেরা করত... প্রত্যেকটা সিনেমার নায়ক নায়িকাদের কেন সুন্দর হতে হয়? তারা কেন আমাদের মত সাদামাটা হয়না? আমাদের মত সাধারণ না হলে আমরা কীভাবে তাদেরকে নিজেদের সঙ্গে রিলেট করব... ( যদিও এখন এসব প্রশ্ন মাথায় আসেনা, কারণ এখনকার র্যাপিস্ট রাও হ্যানসাম্ হয়)।
এইভাবে আমার কলেজ জীবন প্রায় ষোলআনা বৃথা হতে যাচ্ছিল.....
একদিন লোকাল ট্রেনে চেপে কলেজ থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। আমার বাঁপাশে একজন মৌলবি সাহেব বসেছিলেন, ডানদিকে বন্ধু আর সামনে 'লা বেল ডেম সাঁ মাসি'...দা বিউটিফুল লেডি.......।
আমি কলেজে পড়ি, সিঙ্গেল... তাও আবার সেকেন্ড ইয়ার.. সামনের বছর কলেজ লাইফ শেষ.. হঠাৎ করে মারা গেলে স্বর্গে ভগবান যদি প্রশ্ন করে কলেজে পড়েছ অথচ প্রেম করনি? আমি কী উত্তর দেব? সেইসব প্রশ্ন ভেবে আমার মাথা এলোমেলো হয়ে গেল....
আসলে সাহস হয়নি, রিজেকশনের ভয়ে কাউকে প্রপোজ করা হয়নি... হয়তো আমাকেও কেউ মনে মনে চায়তো... যেমন আমিও ছিলাম অনেকের সাইলেন্ট অ্যাডমায়ারার.... যাক্ বাবা! আজ তাও সাহস করে পজিটিভলি ভাবতে পারছি :)
পাশের মৌলবি সাহেবের সঙ্গে আলাপ শুরু হল। উনি আমার পড়াশোনার ব্যাপারে জানতে চাইলেন... তারপর আলোচনা বাড়তে থাকল... একসময় ধর্ম নিয়ে কথা হল, আমি জানালাম ইসলাম ধর্মের মনৌথীজাম্ কনসেপ্টটা আমার ভাল লাগে.... ট্রেনের সকলে মন দিয়ে আমাদের কথা শুনছিল... আলোচনা শেষ হল প্যানথিজম্ দিয়ে... মৌলবি সাহেব পরের স্টেশনে নেমে গেলেন...
আমি ডায়রি নিয়ে পড়াশোনা করার চেষ্টা করছিলাম... একটা শব্দও পড়িনি, সামনে অপ্সরা থাকলে কে লোকাল ট্রেনে পড়াশোনাতে কনসানট্রেট করতে পারে?
কিছুক্ষণ পর মেয়েটি আমার ডাইরি নেওয়ার অনুমতি চাইলো, একটা পৃষ্টাতে দরকারি কিছু একটা লিখবে... ডাইরিটা এগিয়ে দিলাম....
পরের স্টেশনে আমি নেমে গেলাম....
বাড়ি ফিরে ডাইরির পৃষ্ঠা তন্নতন্ন করে খুঁজলাম, শেষ পৃষ্ঠার ডানদিকের নীচে একটা দশ ডিজিটের মোবাইল নম্বর লেখা....
আমার খুব ভাল লাগছিল । নিজেকে পৃথিবীর সম্রাট মনে হচ্ছিল... আত্মপ্রত্যয় শূন্য ডিগ্রি থেকে এক ধাক্কায় একশো ডিগ্রিতে বেড়ে গিয়েছিল। ভাবছিলাম যাদের আমি পছন্দ করি ছুটে গিয়ে তাদের সবাইকে বলতে..........
নেগেটিভিটি আর পজিটিভিটির বেসিক পার্থক্য এটাই.... যখন তুমি নেতিবাচক ভাবনা ভাববে, নঞর্থক সমুদ্রে ডুবে যাবে...সবকিছুই অন্ধকার লাগবে.... অথচ ক্ষণেকের আলো সমস্ত বাঁধা ভেঙে এইভাবেই আমাদের মধ্যে বিপ্লব ঘটাতে পারে....
0 Comments
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন