বাইক এ.... রজনীগন্ধা ফুলের তোড়া আনতে যাচ্ছি..... একটা বাচ্চা মেয়ে তার বাবার হাতের উপর হাত রেখেছে.... বাবা বাইক চালাচ্ছে আর বাহাদুরি বাচ্চি বাবার সামনে এমনভাবে বসে আছে যেন ওই বাইকের চালক.....

মান্তু খুবই মিষ্টি একটি মেয়ে। এক চামচ জলে এক কাপ চিনি মেশালে যতটা মিষ্টি হতে পারে, মান্তু তার থেকেও তেত্রিশ গুণ বেশি মিষ্টি। মান্তুর গায়ের উপর মাঝেমধ্যেই মৌমাছি বসে, অনেক পরে আমি বুঝতে পারি মান্তু আসলে একটি ফুল....

মান্তুর বিছানার চাদরটা খুবই পরিষ্কার। এই চাদরটাতে অনেক গুলো সাপ আছে আর কয়েকটা মই। সাপ লুডো খেলাতে অনেক সময় মই দিয়ে আমরা উপরে উঠি, আবার সাপে কামড়ালে নীচে নেমে যেতে হয়। মান্তুর একটা বালিশ আছে, বালিশে গোলাপ ফুলের ছবি। সেই গোলাপে গন্ধ নেই, কিন্তু রঙ আছে। মান্তুর রঙিন জীবন একদম পছন্দ না, তাই বালিশটা ব্যবহার করেনা।
মান্তুর মায়ের একটা অনেক পুরনো শাড়ি আছে, যেটার রঙ আতা গাছের একশো বছরের পুরনো পাতার মত। সেই কাপড়টা মান্তু সবসময় মাথার কাছে রাখে, বালিশ হিসেবে ব্যবহার করে।

মান্তু এম.এ পড়ে... দাদার দেওয়া স্কুটি নিয়ে মান্তু রোজ বিকেলে বেড়াতে যায়... প্রথম প্রথম দাদাই ওকে ধরেধরে স্কুটি চালানো শিখিয়ে দেয়, এখন একাই সব পারে মান্তু....

মানুষ অত্যন্ত আবেগপ্রবণ প্রাণী। সাধারণত অন্য কাউকে প্রেম করা দেখলেই বেশি একা লাগে নিজের... তখন মনে হয় ইশ! আমার যদি কেউ থাকত... একান্ত আপন কেউ... একান্ত ব্যক্তিগত...
মনের কোণে জমে থাকা সব কথা বলতাম তাকে...
মান্তু পরশুদিন বিকেলে এই কথা গুলোই বলছিল... কথার মধ্যে দু-একটা প্রচলিত গালাগাল দেওয়ার আমার বদভ্যাস.... মান্তুর এই গভীর তাৎপর্যপূর্ণ দার্শনিক এবং মনস্তাত্ত্বিক ব্যখ্যাতে কয়েক ফোঁটা অপব্যখ্যা জুড়ে সিগারেট ধরিয়ে ছিলাম....

মান্তু  অত্যন্ত মিষ্টি একটি মেয়ে। মান্তু রসগোল্লা খায়না। মান্তুর ঠাকুমা মান্তুকে মিষ্টু বলে ডাকে...
আজ বিকেলে কী হয়েছিল জানিনা, মান্তু নেই।
মান্তুর মা ওর পা দুটো বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল।
মৃত্যুর পরিবেশে সব মানুষের চোখে জল আসে, আমারও এসেছিল.... একটা মৃত্যু যেন অনেক মৃত্যুকে মনে করিয়ে দেয়।

ভাবতেও অবাক লাগে... পরশুদিন যার সঙ্গে কথা বললাম সে কীভাবে মুহূর্তের মধ্যে মুছে যেতে পারে? কাল থেকে কী সত্যিই তাকে দেখব না!
সত্যি কথা বলতে কী এখন এসব ভাবার সময় নেই... কয়েকটা রজনীগন্ধার মালা কিনে এখনই ফিরতে হবে... তারপর গোল করে সাজিয়ে বিদায়....

সব কথা সবসময় গুছিয়ে লেখা যায় না। আর আমি একদমই অগোছালো.... তবে বেশ কয়েকটা কথা বলার আছে.... আমার ভাই ও বোনেরা... আমরা জীবনে অনেক ব্যর্থতা, হতাশা, অপমান, লাঞ্ছনার মধ্যে দিয়ে বড় হই.... তাই বলে একজন ভীতু এবং পরাজিত সৈনিকের মত নিজেকে শেষ করার মধ্যে কোনও বীরত্ব আমি দেখিনা....  তারাই প্রকৃত সৈনিক যারা জীবনের যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত  লড়ে যায়....  এখনও অনেক সন্ধ্যায় আমি সূর্যের মত ব্যর্থতায় নুইয়ে পড়ি, তা সত্ত্বেও কখনও চিরতরে অস্ত যাওয়ার কথা ভাবিনি... আত্মহত্যা মানে শুধু নিজেকে হত্যা করা নয়, গোটা পরিবারটাকে মেরে ফেলা, মা-বাবা-দাদা-দিদির মানসিকভাবে মৃত্যু ঘটানো.... প্রত্যেকটা পূজো, ভাইফোঁটার দিনগুলোতে মা অথবা দাদার চোখের জল আর বুকফাটা যন্ত্রণাটা নিজের অনুপস্থিতে একবার যদি বুঝতে পারতে......

সকলে সুস্থ থেকো....