তখন সবে স্মার্ট হতে শিখেছি... সেদিন অর্পিতা দুহাত দিয়ে গাল টিপে বলেছিল, সামনে পারোমিতার জন্মদিন... কী গিফ্ট দিবি???
পারোমিতা আমার থেকে এক বছরের জুনিয়র। কোত্থেকে এসে আমাদের স্কুলে ভর্তি হয়েছে... চুলগুলো ছোটছোট করে কাটা... বেশ ভাল লাগত দেখতে...
অর্পিতা জানতো আমি পারোমিতাকে পছন্দ করি... তাই মাঝেমধ্যে বুঝেশুনে আমার মনে প্রেম জুগিয়ে অনুঘটকের কাজ করত... স্কুলে দাবার বোর্ড নিয়ে ইমতিয়াজ স্যারের বাংলা ক্লাসে আমি শেষ বেঞ্চে বসে রহমানের সঙ্গে দাবা খেলতাম... অর্পিতা বলতো পারোমিতা এসব জানলে বকাঝকা করবে...
তখন সবে জামাপ্যান্ট কেঁচে পরার অভ্যাস হয়েছে। সঙ্গে কমদামী সেন্ট... বিন্দাস ব্র্যান্ডের সেন্ট পাওয়া যেত... তখন প্রথম বুঝতে পারি সাবান মাখলে মুখটা ফরসা লাগে... লাল রঙের জামাতে আমাকে বেশ মানায়...
তখন অনেক কিছু অদ্ভুত শখ ছিল আমার। হাতে কালো কার বেঁধে ঘুরতাম, গলায় ক্রাইস্ট এর লকেট... জানিনা কেন... তবে মনের মস্তানসুলভ অদম্য ইচ্ছেগুলোকে কিছুতেই চেপে রাখতে পারতাম না। হিরো হতে ইচ্ছে হত।
অর্পিতা একটা প্রশ্ন করেছে...। সামনে পারোমিতার জন্মদিন... আমি কী গিফ্ট দেব....
সেসময় মানুষের আয় খুবই কম ছিল। বাবা মা স্কুলে যাওয়ার জন্য দুপাঁচটাকা দিত... তাতে স্কুলের সামনে পাকুড় গাছের তলায় বসা উত্তমের দোকানের ঝালমুড়ি হত... কিন্তু এত কম দামে কোনও গিফ্ট পাওয়া যায়না... তথাপি কোনও দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেসও করা হয়নি... দাদা! আপনার দোকানে পাঁচটাকার গিফ্ট পাওয়া যায়? জন্মদিনের গিফ্ট...
ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়..। তাই কিছু টাকা জোগার করা হল... টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে আর বাকি টাকা সুবিরের কাছে ধার করে দেড়শো টাকা দিয়ে একটা পুতুল কেনা হল... ওগুলোকে কী বলে আমি আজও জানিনা... একটা পৃথিবীর মধ্যে দুটো মানুষ.... মেয়েটার পিঠের নীচে হাত রেখে ছেলেটা হাটু ভাজ করে, একটু ঝুকে দাঁড়িয়ে আছে.... এটা কোনও পুতুল নয়, এটা একটা পরি, না পরি না... এটা পারোমিতা...।
পারোমিতার জন্মদিনের গিফ্ট কেনা হলেও আমার জানা ছিলনা ও বাড়িতে স্পেশাল ভাবে জন্মদিন পালন করবে... এইভাবে লোকজন নিমন্ত্রণ করে আমার জন্মদিন পালন করা হয়না। আর হলেও করতাম না.... এই ধরণের জন্মদিন পালন আজগুবি লাগে আমার... অর্থহীন মনে হয়...।
না। নিমন্ত্রণ পাইনি..। তাই দিনের দিন গিফ্ট দেওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। সেইদিনই সৈকতের মুখে শুনতে পাই পৃথিবীর কথা... পারোমিতা পৃথিবীকে ভালোবাসে...
পরেরদিন টিউশন গেলাম। আগের ব্যাচ পারোমিতার... ওর বিএসএ লেডিবার্ড সাইকেলটা স্যারের উঠোনে দাঁড় করানো... আমি আলতোভাবে সাইকেলটা স্পর্শ করলাম... কেমন একটা তীক্ষ্ণ তেজ অনুভূত হল... তৎক্ষণাৎ হাত সরিয়ে নিলাম...।
পারোমিতা টিউশন থেকে বেরোল... আমি গিফ্টটা নিয়ে ওর হাতে দিলাম...
- শুভ জন্মদিন পারোমিতা। এই প্যাকেটের ভিতর একটা পৃথিবী আছে, তার মধ্যে একটা পরি... আর পরিকে জড়িয়ে ধরে আছে আরেকটা পৃথিবী। যত্ন করে রেখো... এই পৃথিবী বড় অভিমানী... হারিয়ে যেতে পারে....
আমার পৃথিবীটা কিছুক্ষণের জন্য অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। হয়তো আকাশে অনেক মেঘ করেছিল।
মনে হচ্ছিল পৃথিবীর সমস্ত মাধ্যাকর্ষণ শক্তি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এক লাফ দিয়ে পৃথিবী পেরিয়ে অন্যকোথাও চলে গেলে মন্দ হয়না।
Sudip Sen
11 March
0 Comments
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন