স্টেশনের এক প্রান্তের একটি বেঞ্চে খয়েরি রঙের চশমা আর সাদা পাঞ্জাবি পরে যিনি দিন ফুরনোর সময় গুনছেন, তাকে চিনি.... আমি 'নাক্কেল দাদু' বলেই ডাকি... কিন্তু তার তো আজ এখানে থাকার কথা নয়, হায়দ্রাবাদ অথবা স্বর্গে থাকলে আমি বোধহয় একটু বেশিই খুশি হতাম...।

ছোটবেলাতে আমাদের বাড়িতে কোনও নারকেল গাছ ছিল না... তাই পূজা-আর্চার দিনগুলোতে নাক্কেল দাদুর বাড়ি যেতাম নারকেল আনতে....। বাড়িতে গেলে শুধুমাত্র নারকেল দিত তাই নয়, দুএকটা বিস্কুট, সিঙাপুরি কলা, আঙুর ফল... বাড়িতে যাই থাকতো, তাই দিত.. সেসময় খুশির মাধ্যমগুলো সাধ্যের মধ্যে ছিল, তাই এই অল্পতেই অনেক খুশি হতাম.....

নাক্কেল দাদুর আসল নাম ত্রিলোচন দাস। দীর্ঘজীবন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন আর কিছুকিছু টাকা জোগার করে তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন, দুটো ছেলে মানুষ করেছেন। পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষ দুঃখের দিনগুলো সুখ বলে কাটিয়ে দেয় এই ভেবে যে একদিন সুখ আসবেই... সুখ আসবে টিনের চাল-চিরে, দেওয়ালের সমস্ত ফাঁকফোকর দিয়ে...।

এই পৃথিবীতে সুখ বলে কিছু নেই... সুখ একটি আপেক্ষিক বিশেষণ মাত্র। আমরা যা কিছু চাই আর যা পাইনা তার মাঝামাঝিতে সুখের অবস্থান...।

তারপর... টিনের বাক্স আর পিঠের ব্যাগ বইতে বইতে বড় হয়ে উঠলাম, বাসের ছাদে চড়ে কলেজ পৌঁছে গেলাম... কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার সময় নাক্কেল দাদুকে কাঁধে শান্তিনিকেতনি ব্যাগ ঝুলিয়ে বাড়ি ফিরতে দেখতাম।

জীবনটা সোয়াবিনের তরকারি দিয়ে রুটি খাওয়ার মত... এক সময় একঘেয়ে লাগে... আর আমাদের জীবনের প্রত্যেকটা গল্প এরকমই একঘেয়ে...  প্রত্যেকটা জীবনের গল্প একইরকম, তবু মাঝেমধ্যে সস্তার শস মাখিয়ে একটু মশলাময় করার চেষ্টা করার অদম্য চেষ্টা লেগেই থাকে....

এখন ছেলেমেয়ের বিয়ে, নাতিপুতির মুখ দেখা সবই শেষ তবু হাতরে হাতরে সুখের মুখ খোঁজে নাক্কেল দাদু। নিন্দুকেরা বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলে... বৌমা খেতে দেয়না, ছেলেও দেখে না...

এইতো সেইদিন..
নাক্কেল দাদু উঠোনের চেয়ারটাতে বসে, সারা উঠোনময় অগোছালোভাবে পেয়ারার পাতা পড়ে আছে... দোতলা বাড়ির উপরটাতে বৌমা নাতিনাতনি নিয়ে ব্যস্ত, কারও গানের স্কুল তো কারও আঁকার ক্লাস, কারও কোচিং ক্লাস তো কারও ক্রিকেট প্র‍্যাকটিস.... এই ব্যস্ততার মধ্যে বুড়ো শ্বশুরটার জন্য রান্নাবান্না তো দূরের কথা একটু খোঁজখবর নেওয়া খুবই কঠিন তা নিশ্চিতভাবে জানেন নাক্কেল দাদু... সারাদিনের পর বড় ছেলে এসে জিজ্ঞেস করেছিল
- বাবা কিছু খেয়েছ?
উত্তর দেওয়ার জন্য মানসিক বা শারীরিক সামর্থ্য কিছুই ছিল না। বুঝতে পেরেও বৌকে এর কারণ জিজ্ঞেস করার সৎ সাহস হয়নি... সংসার একটি চক্রব্যূহ...।  নিরুপায় হয়ে দুটো কলা দিয়ে এক বাটি মুড়ি মেখে বাবার সামনে দিয়েছিল...।

নাক্কেল দাদু হায়দ্রাবাদে ছোটছেলের কাছে থাকতে পারে। সুখে থাকলেও নিজের ভিটের জন্য মনটা বড্ড টানে, তখন বড় বৌমা ফোন করে...
- বাবা, আজ নারাণ কাকু মারা গেল, আপনার তো ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন একসময়...  চিনতে পারছেন? বাবা আজ বাড়ির পাশের তপনের বাবা মারা গেল....

নাক্কেল দাদু বৌমার না বলা করুণ প্রার্থনা বুঝতে পারে...
'বাবা আপনি কবে যাবেন????'

আজ লোকটা স্টেশনে বসে... আমার সামনাসামনি....  আমিও বাড়ির বড় ছেলে...এইভাবেই একদিন কারও বিরক্তিকর বাবা হব... ক্ষণিকের মুহূর্ত বর্তমানকে ভবিষ্যতের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে... সন্ধের শেষ ট্রেনে সকলে বাড়ি ফিরছে... আর সূর্যটা ধীরেধীরে অস্ত যাচ্ছে....

Sudip Sen
21/03/16