বাসটা এম.জি রোড ক্রস্ করেছে। ঘরিতে তখন চারটে বাজে... বায়ুতে আপেক্ষিক আর্দ্রতা বেশি... অনেকগুলো রোদ আমার মুখে এসে পড়েছে... মনে হচ্ছে রোদগুলো গিলে নিয়ে পেটের খিদে মেটাই...
আজ খুব গরম, শরীর হাঁস-ফাঁস করছে। গরমে আমি খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ি। শহরের সমস্ত ধোঁয়া আমার মুখের রঙ পাল্টে দিচ্ছে, নিজেকে কিলবিশ কিলবিশ মনে হচ্ছে, শক্তিমানের কিলবিশ। বোতল থেকে এক ঢোক জল ঢেলে গলা ভেজালাম। কিছুটা জল হাতে নিয়ে মাথায় মাখলাম। গেঞ্জিটা ভিজে গিয়ে দুর্গন্ধময় হয়েছে।
পেটের ভিতর কেমন একটা মোচড় দিল, সেই মুহূর্তে মনে হল আমি আর পৃথিবীতে নেই। ভিতরের সমস্ত খাবার বেরিয়ে এল পাশে বসে থাকা ব্যক্তির গায়ে লেগে সরাসরি সীমানার বাইরে... বাসের জানালার বাইরে বমির ফোয়ারা ছুটছে... একজন ডাব বিক্রেতা তার দা'টা আমার দিকে দেখাল, বোধহয় আবার যদি দেখা হয় আমাকে কুঁচিকুঁচি করে কাটবে...
পাশের লোকটি ইন করে জামা পরে আপন মনে গান শুনছিলেন, সাজগোছ দেখে মনে হচ্ছে দীর্ঘদিন পর বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে... এমন অবস্থাতে তার গায়ে বমি করে খুব খারাপ লাগছে, খারাপ লাগলেও কী করব বুঝে উঠতে পারছিনা। মনে হচ্ছে মারাত্মক কোনও অপরাধ করে ফেলেছি, আমার ফাঁসি হওয়া উচিত... আবার! আবার বমি হবে... গলা পর্যন্ত এনে এবারের মত গিলে ফেললাম... এক ঢোক জল খেলাম... তারপর আবার হড়হড় করে বমি.....
সবাই আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে, হাসার কারণ শুধু বমি করা নয়। বমির সঙ্গে আমার সামনের পাটির দুটো বাঁধানো দাঁত খোয়া গিয়েছে... নিজেকে কেমন লাগছে আয়নার সামনে দেখতে ইচ্ছে করছেনা... তবে আমার সামনের অসংখ্য আয়না আর তাদের হাসির প্রতিবিম্বে নিজের অরূপ রূপটি স্পষ্টতই চোখে পড়ছে।
বমি হলে খুব কষ্ট হয়। বুক জ্বালা করে। গলা ব্যথা হয়ে যায়, কথা বলা যায়না। শরীরে ক্লান্তি আসে। সেই সমস্ত কষ্ট সহ্য করা যায় না, মনে হয় এর চেয়ে মরে যাওয়া ভাল... বমি হলে পাশের লোকজনের দিকে তাকাতে ইচ্ছে করেনা, তাদের সহানুভূতিশীল চোখের আড়ালে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট দেখা যায়... শারীরিক কষ্টের সঙ্গে এই অপরাধবোধ একাত্ম হয়ে গেলে মনে হয়, এইতো সামনেই রবীন্দ্রসেতু... পাপের শাস্তি হিসেবে নীচে ঝাঁপ মারব...
বাসের কাজ মানুষকে তার গন্তব্যস্থানে পৌঁছে দেওয়া,। জীবনের কাজও তাই, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গাতে পোঁছানো... তার মাঝের সময়ে হিংসে, মারামারি, স্নেহ, ভালোবাসা, অনুরাগ, বিচ্ছেদ, অনুবেদনা আর সহানুভূতি.... আজ, এই মুহূর্তে আমার জীবনের এক সহানুভূতির এপিসোড চলছে, সময়ের স্রোতে সব কিছুই পরিবর্তিত হয়... আর আমি ভাবছি কখন এই অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে মুক্তি পাব....
সবার চোখকে চুম্বকের ন্যায় আকর্ষণ করে যে মেয়েটি বাসে উঠল, সে বোধহয় প্রথম বর্ষের ছাত্রী। হয়তো বাংলা বা ইতিহাস নিয়ে পড়ছে... কলাবিভাগের ছাত্রীদের দেখলেই বোঝা যায়, তাদের চোখমুখ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের মত বুদ্ধিদীপ্ত নয়... আমার চোখটা ঢুলে আসছে, ঘুম পাচ্ছে... সচেতন-অচেতন মনের সংমিশ্রণে মেয়েটির দিকেও চোখ গিয়েছে বার কয়েক...
রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম, এই সময়টাতে অফিস ফেরত মানুষের চাপ কিছুটা বাড়ে... রাস্তার ধারে ডালের বড়া বিক্রি হচ্ছে... ডালের বড়া পেরিয়ে মাছি ওড়া কাটা ফল, ধূপুকাঠির গন্ধ, সেখান থেকে পুরনো বই, পুরনো বই পাশ কাটিয়ে একশো টাকাতে দুটো টিশার্ট, কিছুক্ষণ পর ট্র্যাফিক সিগন্যাল দেখে বাস থেমে গেল, বাসের পাশে সারিসারি স্কুলব্যাগ.......
বাস ছেড়ে দিল। হঠাত বাসের সমস্ত লোক একসাথে চেঁচিয়ে বাস থামানোর নির্দেশ দিল... কারণটা কিছুক্ষণ পর বোঝা গেল....। মেয়েটি নিজের ব্যাগ বাসের মধ্যে রেখে নতুন একটি কিনতে নেমেছিল...।
রোদ অনেকটা কমেছে। চারিদিকে ফুরফুরে হাওয়া বইছে... বেশ আরামদায়ক লাগছে, নিজেকে সুস্থ মনে হচ্ছে।
মুখের ভিতরটাতে কেমন একটা টকটক ভাব। দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে বমির অবশিষ্টাংশ এখনও রয়ে গিয়েছে, মুখের ভিতরে কেমন একটা দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়েছে....
বাস হাওড়া ব্রিজ পার করলো। এক ঢোক জল খেলাম,তারপর নিজের ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে নামার জন্য প্রস্তুত হলাম। মেয়েটি এখনও নামেনি.. তারমানে হাওড়াতে নামবে.....
সবাই হুড়মুড়িয়ে নেমে গেল। আমি তখনও সবার পিছনে। নামার জন্য ধীরেসুস্থে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি... অবশেষে বাসের টিকিট দেখিয়ে নেমে পড়লাম....
- থ্যাংকস....
- অকারণে?
- না। আপনি বাসে ওঠার আগে আমার তিনবার বমি হয়েছিল... তখন সবাই কৌতূহলী দৃষ্টি, সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি আর বিরক্তিকর মেজাজে আমার দিকে চেয়েছিল... অসুস্থ ছিলাম তার উপর অপরাধবোধে নিজেকে কিছুতেই আশ্বস্ত করতে পারছিলাম না। একদিকে শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা, তার উপর হতবুদ্ধি আর কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা... কী করা উচিত বুঝে উঠতে পারছিলাম না.... তখন আপনি বাসে উঠলেন... বাসের সমস্ত মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে আপনি... লোকে আমায় ভুলে, আমার করা অপরাধ নীরবে মাফ করে দিল...
মেয়েটি থতমত খেয়ে গিয়েছে.... অপ্রস্তুত হওয়ার দুটি কারণ থাকতে পারে... আমার সামনের ভাঙা দাঁত দেখে, কিংবা আমার অসহায় অবস্থা দেখেও কেও সাহাহ্য করতে এগিয়ে আসেনি... তাই ভেবে.....।
আমি কোনও কারণ জিজ্ঞেস করিনি... টিকিট কেটে ট্রেনে উঠেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম....
Sudip Sen
27/03
0 Comments
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন