পাঁচশো টাকার নোটটা এই নিয়ে উনিশ বার নাড়াচাড়া করে দেখলাম। বেশ শক্ত, পাঁচ-দশ টাকার নোটের মত অতটা পাতলা নয়। দশ টাকার নোট নিয়ে অনেকবার নৌকা বানিয়েছি, মহাত্মা গান্ধীর মাথায় শিঙ বানিয়েছি, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি বানিয়ে মাথায় পেন দিয়ে দাগিয়ে চুল তৈরি করেছি, যে ভালোবাসেনা তার নাম লিখে, পাশে আই লা ভিউ লিখেছি.... কিন্তু এই পাঁচশো টাকার নোট দিয়ে সেগুলোর কিছুই করতে ইচ্ছে করছে না।
পাঁচশো টাকার নোটের গন্ধটা বেশ তীব্র, একটা ঝিম ধরে থাকা মাথা ঘোরার মত গন্ধ। এই গন্ধটা কি টাকার মূল্যের উপর নির্ধারিত হয়? বেশি টাকায় বেশি গন্ধ, আর কম টাকায় কম গন্ধ... আমার জানা নেই...।
পাঁচশো টাকায় অনেক কিছু হয়। এক বস্তা চাল হয়, চাল না কিনলে এক মাসের মুসুরির ডাল কেনা যায়, তাও না কিনলে কাটা মাছ, আলু, সজনেডাঁটা, পুইশাক, কলমিশাক, বেতোরশাক, লাউ, কুমড়ো, কাঁচা লঙ্কা, পেয়াজ সব কিছু কেনা যায়... গৌতমের রেস্টুরেন্টে ধার দেয় না, ইচ্ছে হচ্ছে ওর মুখের সামনে পাঁচশো টাকা ছুড়ে দিয়ে বলি, কাল থেকে রোজ বিকেলে চাউমিন খাব, সঙ্গে দুটো করে ব্রেড পকোরা আর লাল রঙের দুচামচ ঘণ শস....
রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় গরম লতিকা ভাজা দেখলে খেতে ইচ্ছে হয়। সন্দেশের উপর দিয়ে যখন ভনভন করে মৌমাছি ওড়ে, কয়েক মুহূর্তের জন্য মৌমাছি হয়ে যেতে ইচ্ছে হয়... মায়ের জন্য সোনার কাগজে মোড়া নকল মালা কিনে নিয়ে গেলে খুশি হবে, বোনের জন্য লাল-নীল রঙের কয়েকটা কাচের চুড়ি নিলেও মন্দ হয়না, বোন হাত দুটো নিয়ে ঝনঝন করে বাজাবে... আর আমি মুগ্ধ হয়ে শুনব...
পাঁচশো টাকায় কি একটা পৃথিবী কেনা যাবে? নতুন পৃথিবী... যেখানে বিশ্বায়নের কোনও ছাপ নেই, বইতে পরিবেশ দূষণের সংজ্ঞা পড়তে হয়না, চতুরাশ্রম, বর্ণাশ্রম, বৃদ্ধাশ্রম কোনও কিছুর অস্তিত্ব নেই। ভগবান নেই, আস্তিক নাস্তিক কেউ নেই.... প্রাচীন প্রস্তরযুগ থেকে আবার সেই পৃথিবীটা শুরু হবে....
না... এসবের কোনও কিছুই আমি করতে চাইনা। এই একটা বছর টাকা জমিয়েছি আর অপেক্ষা করেছি, একটা সাইকেল কিনব বলে... দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে আর কত শতাব্দী অপেক্ষা করতে হবে জানিনা, আমি আর ধৈর্য রাখতে পারছিনা। ইচ্ছে হচ্ছে এখনই সাইকেল চালিয়ে গোটা পৃথিবী পরিক্রমা করতে... আর কতক্ষণ?
সাইকেলের উপর দিয়ে প্লাস্টিক জড়ানো। খুলতে ইচ্ছে করছেনা। এগুলো সাইকেলের নতুন জামাকাপড়, খুলে দিলেই পুরনো হয়ে যাবে... দু'বার বেলটা বাজালাম... ক্লিংক্লিং শব্দ... বেশ ভাল শব্দ... শুধুমাত্র সাইকেলের বেল বাজিয়ে আজ পর্যন্ত কোনও গান রেকর্ডিং করা হয়নি... হয়তো কোনও সঙ্গীত অনুরাগী এখনও এই অসামান্য শব্দ আবিষ্কার করতে পারেনি।
খুব ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে আমি কোনও সাইকেলে না, পক্ষীরাজের ঘোড়া চড়ে আকাশে উড়ছি। একটা মেঘ পার করে আরেকটা মেঘের উপর দিয়ে উড়ে চলেছি। ইচ্ছে হচ্ছে এখনই বাড়ি ফিরে যাই... মাকে সাইকেলে চাপিয়ে নিয়ে ঘুরি, তারপর বাবাকে, বোনকে বলি চোখ বন্ধ কর, দ্যাখ আমরা কত দূর চলে যাব... তুই টেরই পাবিনা... তবে সাবধান! অনেকক্ষণ সাইকেলে চেপে থাকলে পায়ে ঝিঁঝিঁ ধরবে, তখন তোর পায়ের থেকে চটি খুলে পড়ে গেলেও টের পাবিনা...।
এই সমস্ত কোনও ইচ্ছেই আজ পূরণ হবে না। আকাশে ঘন মেঘ করেছে অবিলম্বে বাড়ি ফিরতে হবে... আমি সাইকেল নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম...
জামা-গেঞ্জি ভিজে কাদা... সমস্ত শরীরটা সাইকেলটার উপর রেখেও ওটাকে ভেজার হাত থেকে রক্ষা করতে পারিনি... চারিদিকে ঝরঝরিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে... সঙ্গে বিদ্যুতের চমক... খুব কষ্ট হচ্ছে... আমার নতুন সাইকেলটা আজ ভিজে গেল?
গাছটার নীচে আমি বসে আছি.. সাইকেলটা এখনও ভিজছে... একটা শ্বাসকষ্টের মত চাপা কষ্ট বুকটাতে আটকে আছে, নাক দিয়ে অনবরত জল বেরোচ্ছে... সাইকেলের সমস্ত শরীর দিয়ে টুপটাপ করে জল বেয়ে পড়ছে.... আজ জ্বর আসবে... সাইকেলটার অঘোরে জ্বর আসবে আজ... এই পৃথিবীর কোনও দাক্তার তাকে সুস্থ করতে পারবেনা......
Sudip Sen
28/03
0 Comments
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন