#মহাবাম
লুঙির নীচ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে আন্ডারপ্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল বের করল লোকটা, পুলিশকে ফোন করছে।
আমি ক্লরমিন্ট চিবোচ্ছি। এখানে একটা সত্যি কথা বলা প্রয়োজন; আমার মুখ দিয়ে প্রচণ্ড দুর্গন্ধ বেরোয়, বিশেষত যেদিন আমি আলুভাজা দিয়ে ডালভাত খাই। আমার এই বুড়ো বয়সেও ব্যাচেলর অবস্থার জন্য কিছুটা মুখের দুর্গন্ধ অবশ্যই দায়ী। নামীদামী কোম্পানির মাউথওয়াশ থেকে শুরু করে মুখে দারুচিনি রাখা, দিনে পাঁচবার দাঁত ব্রাশ করা, অতিমাত্রায় তেলেভাজা না খাওয়া, গরম দুধ আর ঠান্ডা জল পান থেকে নিজেকে বিরত রাখা..... প্রায় সমস্ত প্রচেষ্টা যখন বিফলে, আমি পাড়ার পির বাবার কাছে গেলাম, একটা ঘোড়া দিয়ে মানত করলাম আল্লাহ্ বা ভগবান, তুমি যাই হও, পরের জন্মে এই মুখে দুর্গন্ধ থেকে আমায় নিস্তার দিও।
লোকটার আন্ডারপ্যান্ট নীল রঙের। নীল রঙের আন্ডারপ্যান্ট সচরাচর চোখে পড়েনা। এখনকার মডার্ন যুগে এক বুড়ো দাদু ছাড়া সবাই জাঙ্গিয়া পরে। যা দু-একটা আন্ডারপ্যান্ট চোখে পড়ে তা সাদা রঙের।
জগৎসংসারে কিছুকিছু লোকজন আছে যাদের চোখমুখ মায়াভরা, মারাত্মক অপরাধ করলেও চোখমুখ দেখে বিশ্বাস করা যায়না এই প্রকৃত দোষী, এক লোকটা তাদের মধ্যে একজন। আমি নিজেও আয়নার সামনে কয়েকবার দাঁড়িয়ে নিজেকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি, চোর ছ্যাঁচড় ছাড়া কিছুই মনে হয়নি কোনওদিন। নিজেকে দেখে একেক সময় দুর্ভিক্ষপীড়িত মনে হয়, কিংবা পূর্বজন্মে পোলিও রোগাক্রান্ত ছিলাম, ইহজন্মেও তা পূর্ণরূপে আরোগ্যলাভ করতে পারেনি। বারকয়েক এরকমও ভেবেছি নিজেই একজন নারী হলে আমার পুরুষ সত্তার সঙ্গে প্রেম করার ইচ্ছে প্রকাশ করতাম না কখনও। নিজেকে ক্যামন মুড়ি-চানাচুর খাওয়া উচ্চিংড়ে মনে হয়, অথচ অনেকবার চেয়েছি সন্দেশ খাওয়া বীর পুরুষ হতে।
লোকটি ফোন করল...
- হ্যালো পুলিশ! শীঘ্রই স্টেশনে আসুন, শম্ভু মাতাল জব্বর এক কেস ঘটিয়েছে, মেয়েছেলে ঘটিত কেস।
প্রত্যেকজন মানুষ জীবনে কিছু মহান স্বপ্ন নিয়ে বড় হয়। একেক সময় স্বপ্নগুলো হারিয়ে যায়, অথবা রাত পেড়িয়ে ভোর হওয়ার আগেই ঘুম ভেঙে যায়। এরকম ঘুমের ঘোরে আমিও দীর্ঘদিন কাটিয়েছি। ছোটবেলাতে যখন বাড়ির সামনের হাসপাতালে ভিন গাঁয়ের লোক এসে লাইন দিত, দাক্তার বাবু টেথিস্কোপের একপ্রান্ত কানে লাগিয়ে হৃতস্পন্দন পরিমাপ করত, আমার দাক্তার হতে ইচ্ছে করত। দাক্তার হয়েছিও বার কয়েক। শরীরের কোনও রোগ দেখা দিলেই ওষুধের ঘর থেকে অ্যান্টি চারটে, প্যারা চারটে নিয়ে খেয়ে নিয়েছি। রোগও সেরে গিয়েছে।
মাথায় হলুদ রঙের হেলমেট দেখে ইঞ্জিনিয়ারও হয়েছি, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। কালবৈশাখীর ঝড়ে যখন লোকজনের রান্নার চালা উড়ে যেত, আমি বাঁশ কেটে নতুন চালা বানিয়ে দিয়েছি, দর্মার বেড়া বানিয়েছি। সেই অর্থে লোকজন এখনও আমায় ইঞ্জিনিয়ার বলেই ডাকে।
একটা সময় ভাবলাম দাক্তার ইঞ্জিনিয়ার সব হওয়া কমপ্লিট, এবার জীবনমুখী কোনও কোর্স করার প্রয়োজন। তার পর থেকেই আমার ট্রেনে ট্রেনে যাতায়াত। অবনী ঘোষের ডবল অ্যাক্সন বিদ্যুৎ বাম।
আমার হাতে একটা স্ক্রিপ্ট আছে। পড়ে শোনায়.....
মাথার যন্ত্রণা, দীর্ঘদিনের চোট লাগা ব্যথা, মচকা লাগা ব্যথা, বাতের ব্যথা, গিটেগিটে ব্যথা, জয়েন্টে জয়েন্টে ব্যথা মালিশ করবেন, অবনী ঘোষের ডবল অ্যাক্সন বিদ্যুত্ বাম।
আমার জীবনের বিখ্যাত স্বরচিত রচনার মধ্যে এটি শ্রেষ্ঠ। সম্পূর্ণ স্ক্রিপ্ট লিখতে আমার সপ্তাধীক সময় লেগেছে।
শম্ভু মাতালের চারিদিকে লোকজন জড়ো হয়েছে। আমার পাড়াতেই বাড়ি শম্ভুর। সারাদিন বৌয়ের সঙ্গে ঝগড়া লেগেই আছে। আজ বাড়ি থেকে আসবার সময় দেখলাম শম্ভু চিনি দিয়ে মুড়ি ভিজিয়ে খাচ্ছে। এই দরিদ্র সংসারে এমন শান্তি দেখলে মাঝেমধ্যে আমার চোখে জল আসে। শম্ভুর দুঃখের কথাও শুনেছি বারকয়েক, বৌ শিক্ষিত, আশাকর্মী। নিরক্ষর স্বামীর শিক্ষিত বৌ হলে স্বামীর স্বায়ত্তশাসন থাকেনা। শ্বশাসনের অজুহাতে রাজ্যগ্রাসের একতরফা অধীকার থাকে স্ত্রীর হাতে। তেমনই অধীকারে শম্ভুর পারিবারের পারিবারিক প্রধান ওর স্ত্রী। শম্ভু কাঁদছিল। হয়তো নেশার ঘোড়ে। বৌ চায় হিসেব করে চলতে, দুধের হিসেব, গ্যাসের খরচ, বিদ্যুতের বিল, মাসে ক'কেজি চাল লাগছে, সপ্তাহে দুদিন আমিষ, তিনদিন নিরামিষ। সবই ভাল লাগে শম্ভুর, শুধু রাতবিরেত বৌ আর তার জামাইবাবুর নিষিদ্ধ ফোনালাপ কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারেনা। ছেলেটাও বড় হচ্ছে, সেও তো মায়ের সঙ্গে পরপুরুষের সম্পর্কের কথা টের পাবে একদিন। শম্ভুর ভাবতে ভাল লাগেনা এসব। মানুষের যখন কোনও কিছু ভাল লাগেনা, সে মুক্তি চায়, নিস্তার চায়। শম্ভুর বিশ্বাস ওর মুক্তি দেশী মদ এ।
পুলিশ এসেছে, মেলা লোক জড়ো হয়েছে।
বিদ্যুত্ বাম বিক্রি করে রোজকার রুটিরুজি হয়ে যায়। সমস্যা হয় হঠাৎ কোনওদিন শারীরিক অসুস্থতা দেখা দিলে। একটু জ্বর এলে গা ম্যাজম্যাজ করে, উঠতে ইচ্ছে করেনা। অথচ একদিন কাজে না গেলে চুলোয় হাঁড়ি চাপেনা। আর তাছাড়াও কাজে যাওয়াতেই আমার আগ্রহ বেশি, রোজ আট' টা পঞ্চাশ এর ব্যান্ডেল লোকালের লেডিস কামরার তিন নম্বর সিট। মাঝেমধ্যে মনে হয় আমার বেঁচে থাকার উৎস ওই তিন নম্বরি সিট টা। হলুদ চুড়িদার, কানে দুটো গোলাকার দুল, কুচফলের পাতার মত ছোট্ট নাকের নথ,
আর ভ্রুবিভঙ্গের মাঝখানের ছোট্ট সাদা টিপ, এই টিপের নামে আমি লিখেছি আমার জীবনের দস্তাবেজ।
শম্ভুর আসল বাড়ি কোথায় আমার জানা নেই, তবে বিয়ের পরপরেই আমাদের পাড়াতে চলে আসে। তখন সংসারের চাহিদা কম ছিল, শান্তি ছিল। বিয়ের প্রথম প্রথম সব স্বামী স্ত্রী একে অপরকে পেয়ে পূর্ণপরিতৃপ্ত হয়, তারপর ধীরে ধীরে শারীরিক, মানসিক আকর্ষণ কমতে থাকে। এক সময় মনে হয় সংসারে অশান্তি ছাড়া আর কোনও কিছু অবশিষ্ট নেই। শম্ভুর এখন সেই অবস্থা।
আজ বাজার খারাপ, ভাল বিক্রি হয়নি। কিছুটা মন মরা হয়ে বসে আছি। কাল চাল কিনতে হবে, মুসুরির ডাল, হলুদ, সর্ষের তেল, চা, চিনি সবই ফুরানোর মুখে। মুখের ক্লরমিন্ট সাদা ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে, ফেলার জন্য এগিয়ে গেলাম।
ওভারব্রিজে হইচই শুরু হয়েছে। কেউকেউ বলছে ব্রিজ থেকে ছুড়ে ফেলে দাও মাল টাকে, শালা মাতাল কোথাকার!
না! ব্যাপারটা আসলে কী জানা দরকার। বিদ্যুত্ বামের ব্যাগটা হাতে নিয়ে আমি ওভারব্রিজের দিকে এগিয়ে গেলাম।
শম্ভুকে সবাই মিলে ধরে 'যেমন খুশি মারো' খেলছে। গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে একজন কম বয়সী যুবা শম্ভুর নাকে ঘুষি চালালো, হয়তো কোনও পুরনো শত্রুতার প্রতিশোধ অথবা কাউকে মেরে হাতের সুখ পাওয়া যায় তাই মারা। নাক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে টুপটাপ করে মাটিতে পড়ছে। আমি বাঁচানোর চেষ্টা করতে গেলে দু-এক ঘা আমার পিঠেও পড়লো। শম্ভু সত্যিই মহাপাপী, সে মহা অপরাধ করেছে। দুর্গার ভিক্ষার থালা থেকে পয়সা চুরি করেছে। দুর্গা দীর্ঘদিন ভিক্ষা করছে এই স্টেশনের ওভারব্রিজে, শেষমেশ ওর বাটি থেকে পয়সা চুরি করল শম্ভু মদ খাওয়ার জন্য!
মারতে মারতে একসময় মানুষ ক্লান্ত হয়ে যায়। শম্ভু স্টেশনে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, চোখ মুখ দিয়ে গড়গড় করে রক্ত বেরোচ্ছে। একটা কুকুর এল, শম্ভুর নাকমুখ শুঁকে চলে গেল। কুকুরও জানে শম্ভু ঘৃণার কাজ করেছে, ওর প্রতি সমবেদনা জানানোর কোনও মানে হয়না। একমাত্র দুর্গা কষ্টে থাকতে পারলো না বোধহয়। মেয়েদের মনে মা বাস করে।
- দাদাবাবু! শম্ভুকে হাসপাতালে নিয়ে যান।
মানুষ তখনই বেশি আদরযত্ন পায়, যখন সে অসুস্থ অথবা মৃতপ্রায়। আমি নিজের কথা ভুলে শম্ভুর জন্য এক গ্লাস দুধ, দুটো পাউরুটি আর একটা ডিম কিনে নিয়ে গেলাম। ওর বাড়িতে খবর দেওয়া হয়েছে।
রাত তখন আট টা, আমি হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে একটা মেজদার বিড়ি ধরিয়েছি, শম্ভুর বৌ এসে হাউমাউ করে কান্না করছে, মা কাঁদছে দেখে ওর ছেলেও সুর মিলাচ্ছে।
- দাদাকে বাঁচানোর জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
হাসপাতালের আলো হলুদ রঙের চুড়িদারের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গেছে। সাদা টিপটা চকচক করছে, কখনও মনে হচ্ছে তারাখশা। এই মুহূর্তে একটাই প্রার্থনা করতে ইচ্ছে করছে......
"চির সখা হে, ছেড়োনা মোরে ছেড়োনা।"
হাসপাতালে অনেক শিশুর জন্ম হয়, অথচ একটা প্রেম কিভাবে জন্মাতে পারে? নিজের চোখকে আমি বিশ্বাস করতে পারছিনা। তবে কী স্বপ্ন দেখছি। নিজের গালে ঠাটিয়ে এক থাপ্পড় মারলাম, প্রচণ্ড লাগল সাথেসাথে হলুদ চুড়িদার - সাদা টিপ খিলখিল করে হেসে উঠল। মেজদার বিড়ি সচরাচর খাইনা আমি, মেজদার বিড়ি বড্ড কড়া, আজ নেশা হয়ে গিয়েছে বোধহয়।
Sudip Sen
Third Feb Sixteen
লুঙির নীচ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে আন্ডারপ্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল বের করল লোকটা, পুলিশকে ফোন করছে।
আমি ক্লরমিন্ট চিবোচ্ছি। এখানে একটা সত্যি কথা বলা প্রয়োজন; আমার মুখ দিয়ে প্রচণ্ড দুর্গন্ধ বেরোয়, বিশেষত যেদিন আমি আলুভাজা দিয়ে ডালভাত খাই। আমার এই বুড়ো বয়সেও ব্যাচেলর অবস্থার জন্য কিছুটা মুখের দুর্গন্ধ অবশ্যই দায়ী। নামীদামী কোম্পানির মাউথওয়াশ থেকে শুরু করে মুখে দারুচিনি রাখা, দিনে পাঁচবার দাঁত ব্রাশ করা, অতিমাত্রায় তেলেভাজা না খাওয়া, গরম দুধ আর ঠান্ডা জল পান থেকে নিজেকে বিরত রাখা..... প্রায় সমস্ত প্রচেষ্টা যখন বিফলে, আমি পাড়ার পির বাবার কাছে গেলাম, একটা ঘোড়া দিয়ে মানত করলাম আল্লাহ্ বা ভগবান, তুমি যাই হও, পরের জন্মে এই মুখে দুর্গন্ধ থেকে আমায় নিস্তার দিও।
লোকটার আন্ডারপ্যান্ট নীল রঙের। নীল রঙের আন্ডারপ্যান্ট সচরাচর চোখে পড়েনা। এখনকার মডার্ন যুগে এক বুড়ো দাদু ছাড়া সবাই জাঙ্গিয়া পরে। যা দু-একটা আন্ডারপ্যান্ট চোখে পড়ে তা সাদা রঙের।
জগৎসংসারে কিছুকিছু লোকজন আছে যাদের চোখমুখ মায়াভরা, মারাত্মক অপরাধ করলেও চোখমুখ দেখে বিশ্বাস করা যায়না এই প্রকৃত দোষী, এক লোকটা তাদের মধ্যে একজন। আমি নিজেও আয়নার সামনে কয়েকবার দাঁড়িয়ে নিজেকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি, চোর ছ্যাঁচড় ছাড়া কিছুই মনে হয়নি কোনওদিন। নিজেকে দেখে একেক সময় দুর্ভিক্ষপীড়িত মনে হয়, কিংবা পূর্বজন্মে পোলিও রোগাক্রান্ত ছিলাম, ইহজন্মেও তা পূর্ণরূপে আরোগ্যলাভ করতে পারেনি। বারকয়েক এরকমও ভেবেছি নিজেই একজন নারী হলে আমার পুরুষ সত্তার সঙ্গে প্রেম করার ইচ্ছে প্রকাশ করতাম না কখনও। নিজেকে ক্যামন মুড়ি-চানাচুর খাওয়া উচ্চিংড়ে মনে হয়, অথচ অনেকবার চেয়েছি সন্দেশ খাওয়া বীর পুরুষ হতে।
লোকটি ফোন করল...
- হ্যালো পুলিশ! শীঘ্রই স্টেশনে আসুন, শম্ভু মাতাল জব্বর এক কেস ঘটিয়েছে, মেয়েছেলে ঘটিত কেস।
প্রত্যেকজন মানুষ জীবনে কিছু মহান স্বপ্ন নিয়ে বড় হয়। একেক সময় স্বপ্নগুলো হারিয়ে যায়, অথবা রাত পেড়িয়ে ভোর হওয়ার আগেই ঘুম ভেঙে যায়। এরকম ঘুমের ঘোরে আমিও দীর্ঘদিন কাটিয়েছি। ছোটবেলাতে যখন বাড়ির সামনের হাসপাতালে ভিন গাঁয়ের লোক এসে লাইন দিত, দাক্তার বাবু টেথিস্কোপের একপ্রান্ত কানে লাগিয়ে হৃতস্পন্দন পরিমাপ করত, আমার দাক্তার হতে ইচ্ছে করত। দাক্তার হয়েছিও বার কয়েক। শরীরের কোনও রোগ দেখা দিলেই ওষুধের ঘর থেকে অ্যান্টি চারটে, প্যারা চারটে নিয়ে খেয়ে নিয়েছি। রোগও সেরে গিয়েছে।
মাথায় হলুদ রঙের হেলমেট দেখে ইঞ্জিনিয়ারও হয়েছি, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। কালবৈশাখীর ঝড়ে যখন লোকজনের রান্নার চালা উড়ে যেত, আমি বাঁশ কেটে নতুন চালা বানিয়ে দিয়েছি, দর্মার বেড়া বানিয়েছি। সেই অর্থে লোকজন এখনও আমায় ইঞ্জিনিয়ার বলেই ডাকে।
একটা সময় ভাবলাম দাক্তার ইঞ্জিনিয়ার সব হওয়া কমপ্লিট, এবার জীবনমুখী কোনও কোর্স করার প্রয়োজন। তার পর থেকেই আমার ট্রেনে ট্রেনে যাতায়াত। অবনী ঘোষের ডবল অ্যাক্সন বিদ্যুৎ বাম।
আমার হাতে একটা স্ক্রিপ্ট আছে। পড়ে শোনায়.....
মাথার যন্ত্রণা, দীর্ঘদিনের চোট লাগা ব্যথা, মচকা লাগা ব্যথা, বাতের ব্যথা, গিটেগিটে ব্যথা, জয়েন্টে জয়েন্টে ব্যথা মালিশ করবেন, অবনী ঘোষের ডবল অ্যাক্সন বিদ্যুত্ বাম।
আমার জীবনের বিখ্যাত স্বরচিত রচনার মধ্যে এটি শ্রেষ্ঠ। সম্পূর্ণ স্ক্রিপ্ট লিখতে আমার সপ্তাধীক সময় লেগেছে।
শম্ভু মাতালের চারিদিকে লোকজন জড়ো হয়েছে। আমার পাড়াতেই বাড়ি শম্ভুর। সারাদিন বৌয়ের সঙ্গে ঝগড়া লেগেই আছে। আজ বাড়ি থেকে আসবার সময় দেখলাম শম্ভু চিনি দিয়ে মুড়ি ভিজিয়ে খাচ্ছে। এই দরিদ্র সংসারে এমন শান্তি দেখলে মাঝেমধ্যে আমার চোখে জল আসে। শম্ভুর দুঃখের কথাও শুনেছি বারকয়েক, বৌ শিক্ষিত, আশাকর্মী। নিরক্ষর স্বামীর শিক্ষিত বৌ হলে স্বামীর স্বায়ত্তশাসন থাকেনা। শ্বশাসনের অজুহাতে রাজ্যগ্রাসের একতরফা অধীকার থাকে স্ত্রীর হাতে। তেমনই অধীকারে শম্ভুর পারিবারের পারিবারিক প্রধান ওর স্ত্রী। শম্ভু কাঁদছিল। হয়তো নেশার ঘোড়ে। বৌ চায় হিসেব করে চলতে, দুধের হিসেব, গ্যাসের খরচ, বিদ্যুতের বিল, মাসে ক'কেজি চাল লাগছে, সপ্তাহে দুদিন আমিষ, তিনদিন নিরামিষ। সবই ভাল লাগে শম্ভুর, শুধু রাতবিরেত বৌ আর তার জামাইবাবুর নিষিদ্ধ ফোনালাপ কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারেনা। ছেলেটাও বড় হচ্ছে, সেও তো মায়ের সঙ্গে পরপুরুষের সম্পর্কের কথা টের পাবে একদিন। শম্ভুর ভাবতে ভাল লাগেনা এসব। মানুষের যখন কোনও কিছু ভাল লাগেনা, সে মুক্তি চায়, নিস্তার চায়। শম্ভুর বিশ্বাস ওর মুক্তি দেশী মদ এ।
পুলিশ এসেছে, মেলা লোক জড়ো হয়েছে।
বিদ্যুত্ বাম বিক্রি করে রোজকার রুটিরুজি হয়ে যায়। সমস্যা হয় হঠাৎ কোনওদিন শারীরিক অসুস্থতা দেখা দিলে। একটু জ্বর এলে গা ম্যাজম্যাজ করে, উঠতে ইচ্ছে করেনা। অথচ একদিন কাজে না গেলে চুলোয় হাঁড়ি চাপেনা। আর তাছাড়াও কাজে যাওয়াতেই আমার আগ্রহ বেশি, রোজ আট' টা পঞ্চাশ এর ব্যান্ডেল লোকালের লেডিস কামরার তিন নম্বর সিট। মাঝেমধ্যে মনে হয় আমার বেঁচে থাকার উৎস ওই তিন নম্বরি সিট টা। হলুদ চুড়িদার, কানে দুটো গোলাকার দুল, কুচফলের পাতার মত ছোট্ট নাকের নথ,
আর ভ্রুবিভঙ্গের মাঝখানের ছোট্ট সাদা টিপ, এই টিপের নামে আমি লিখেছি আমার জীবনের দস্তাবেজ।
শম্ভুর আসল বাড়ি কোথায় আমার জানা নেই, তবে বিয়ের পরপরেই আমাদের পাড়াতে চলে আসে। তখন সংসারের চাহিদা কম ছিল, শান্তি ছিল। বিয়ের প্রথম প্রথম সব স্বামী স্ত্রী একে অপরকে পেয়ে পূর্ণপরিতৃপ্ত হয়, তারপর ধীরে ধীরে শারীরিক, মানসিক আকর্ষণ কমতে থাকে। এক সময় মনে হয় সংসারে অশান্তি ছাড়া আর কোনও কিছু অবশিষ্ট নেই। শম্ভুর এখন সেই অবস্থা।
আজ বাজার খারাপ, ভাল বিক্রি হয়নি। কিছুটা মন মরা হয়ে বসে আছি। কাল চাল কিনতে হবে, মুসুরির ডাল, হলুদ, সর্ষের তেল, চা, চিনি সবই ফুরানোর মুখে। মুখের ক্লরমিন্ট সাদা ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে, ফেলার জন্য এগিয়ে গেলাম।
ওভারব্রিজে হইচই শুরু হয়েছে। কেউকেউ বলছে ব্রিজ থেকে ছুড়ে ফেলে দাও মাল টাকে, শালা মাতাল কোথাকার!
না! ব্যাপারটা আসলে কী জানা দরকার। বিদ্যুত্ বামের ব্যাগটা হাতে নিয়ে আমি ওভারব্রিজের দিকে এগিয়ে গেলাম।
শম্ভুকে সবাই মিলে ধরে 'যেমন খুশি মারো' খেলছে। গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে একজন কম বয়সী যুবা শম্ভুর নাকে ঘুষি চালালো, হয়তো কোনও পুরনো শত্রুতার প্রতিশোধ অথবা কাউকে মেরে হাতের সুখ পাওয়া যায় তাই মারা। নাক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে টুপটাপ করে মাটিতে পড়ছে। আমি বাঁচানোর চেষ্টা করতে গেলে দু-এক ঘা আমার পিঠেও পড়লো। শম্ভু সত্যিই মহাপাপী, সে মহা অপরাধ করেছে। দুর্গার ভিক্ষার থালা থেকে পয়সা চুরি করেছে। দুর্গা দীর্ঘদিন ভিক্ষা করছে এই স্টেশনের ওভারব্রিজে, শেষমেশ ওর বাটি থেকে পয়সা চুরি করল শম্ভু মদ খাওয়ার জন্য!
মারতে মারতে একসময় মানুষ ক্লান্ত হয়ে যায়। শম্ভু স্টেশনে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, চোখ মুখ দিয়ে গড়গড় করে রক্ত বেরোচ্ছে। একটা কুকুর এল, শম্ভুর নাকমুখ শুঁকে চলে গেল। কুকুরও জানে শম্ভু ঘৃণার কাজ করেছে, ওর প্রতি সমবেদনা জানানোর কোনও মানে হয়না। একমাত্র দুর্গা কষ্টে থাকতে পারলো না বোধহয়। মেয়েদের মনে মা বাস করে।
- দাদাবাবু! শম্ভুকে হাসপাতালে নিয়ে যান।
মানুষ তখনই বেশি আদরযত্ন পায়, যখন সে অসুস্থ অথবা মৃতপ্রায়। আমি নিজের কথা ভুলে শম্ভুর জন্য এক গ্লাস দুধ, দুটো পাউরুটি আর একটা ডিম কিনে নিয়ে গেলাম। ওর বাড়িতে খবর দেওয়া হয়েছে।
রাত তখন আট টা, আমি হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে একটা মেজদার বিড়ি ধরিয়েছি, শম্ভুর বৌ এসে হাউমাউ করে কান্না করছে, মা কাঁদছে দেখে ওর ছেলেও সুর মিলাচ্ছে।
- দাদাকে বাঁচানোর জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
হাসপাতালের আলো হলুদ রঙের চুড়িদারের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গেছে। সাদা টিপটা চকচক করছে, কখনও মনে হচ্ছে তারাখশা। এই মুহূর্তে একটাই প্রার্থনা করতে ইচ্ছে করছে......
"চির সখা হে, ছেড়োনা মোরে ছেড়োনা।"
হাসপাতালে অনেক শিশুর জন্ম হয়, অথচ একটা প্রেম কিভাবে জন্মাতে পারে? নিজের চোখকে আমি বিশ্বাস করতে পারছিনা। তবে কী স্বপ্ন দেখছি। নিজের গালে ঠাটিয়ে এক থাপ্পড় মারলাম, প্রচণ্ড লাগল সাথেসাথে হলুদ চুড়িদার - সাদা টিপ খিলখিল করে হেসে উঠল। মেজদার বিড়ি সচরাচর খাইনা আমি, মেজদার বিড়ি বড্ড কড়া, আজ নেশা হয়ে গিয়েছে বোধহয়।
Sudip Sen
Third Feb Sixteen
0 Comments
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন