ফিজিক্স নিয়ে পড়াশোনা করলেও আমি ইতিহাস ভূগোল পড়াতে ভালোবাসি। কারণ, প্রত্যেকটা মানুষের জীবনে ইতিহাস জানাটা জরুরি। ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ আর আত্মাভিমান কিভাবে একটা সাম্রাজ্যের পতন ঘটায় তা প্রত্যেকের অবগত থাকা উচিত।

এমন খুব কম সংখ্যক বাঙালি মধ্যবিত্ত সন্তান আছে যারা জীবনের কোনও না কোনও সময় টিউশন করেনি। শুধুমাত্র কয়েকটা টাকার আশায় নয়, কমবয়সে নিজেকে শিক্ষক ভাবার মধ্যে এক অদ্ভুত মুগ্ধতা কাজ করে। কাউকে শেখানোর যে তৃপ্তি, তা বোধহয় আর অন্য কিছুতে পাওয়া যায়না।
শুধুমাত্র কয়েকটা বই পড়িয়ে নয়, একটা বাচ্চাকে পড়ানোর সময় তাকে নিপুণভাবে পর্যবেক্ষণ করলে অনেক কিছু শেখা যায়। বোঝা যায় নিজের মধ্যে এই বয়সেও অনেক বদ অভ্যাস বিদ্যমান। শিশুদের নির্মলতা, নিষ্কলুষতা আর পবিত্রতা অনেক সময় আমাদের নতুন করে বাঁচার অনুপ্রেরণা যোগায়।

আমিও ইতিহাস পড়াতে যেতাম। সাধারণত বিকেল চারটে হল টিউশন পড়ানোর সরকারি সময়। যার বাড়িতে পড়াতাম তিনি আমার প্রাক্তন শিক্ষক, এখনও স্কুলে শিক্ষকতা করেন। সাধারণত আমি খুব পাংচুয়াল, তাই নির্দিষ্ট সময়ের পাঁচ মিনিট আগেই পৌঁছে যেতাম। ভাঙা সাইকেল টা দোরগোড়াতে দাঁড় করিয়ে কলিং বেলে হাত রাখতাম।

আচ্ছা, কিছু কথা এখানেই বলে নেওয়া প্রয়োজন। সাধারণত মানুষজন ভাবেন যারা বেকার, রোজকারপাতি কিচ্ছুটি করেনা, তারা ভাল পড়াতে জানেনা। অথচ, সেই যখন একটা চাকরি পেয়ে যায়, ব্যাস! মানুষ ভাবতে থাকে তার সমস্ত বিদ্যা রাতারাতি অর্জিত হয়েছে। শুনতে খারাপ লাগলেও একথা সত্যি যে, একজন টিউশনের শিক্ষক মান-মর্যাদা কখনোই একজন স্কুলের প্রকৃত শিক্ষকের মত পান না। এমনকি অনেকসময় বাড়ির মাসকাবারি  কাজের লোকের মত তাদের সাথে আচরণ করা হয়।

তো যাইহোক, বেলের আওয়াজে পূজানিয় শিক্ষক মহাশয়ের স্ত্রী বাড়ির গেট খুললেন। সেসময় নিজের বড় খারাপ লাগত, অযথা একজনের ঘুম ভাঙানোর কারণে নিজের ভিতরে কেমন যেন পাপবোধ কাজ করত। মুষ্টিবদ্ধ হাত নিয়ে চোখ রগড়াতে রগড়াতে তাচ্ছিল্যের সুরে তিনি বলতেন
'অ: তুমি!'
বুঝতেই পারতাম, মহাশয়ার কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটি আর যেইহোক, আমি নই।
একজন শিক্ষিত পরিবারের কাছ থেকে আমার মত ফিজিক্সের ছাত্রের প্রতি এইরূপ আচরণ (যে বাড়ির কর্তা আমার প্রাক্তন শিক্ষক) হয়তো প্রত্যাশিত নয়। আমি স্যারের বাড়িতে পড়াতে গিয়ে কোনওদিন চা খাইনি, পাছে কাকিমার কষ্টের কথা ভেবে করুণা হত।

গ্রামবাংলার অবস্থা আরও খারাপ। সেখানে একজন টিউশনের শিক্ষক ন্যূনতম 'মজুরি' টুকুও পাননা। আমার এক বন্ধু তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র, এক বাড়িতে পাঁচদিন পড়িয়ে দেড়শ টাকা পেত।
তারপরেও চলে দরাদরি । মাস শেষ হলে সবকিছু যোগার হলেও টিউশনের স্যারের মাইনে কিছুতেই যেন যোগার হতে চায়না। অথচ, যে স্যার রোজ বিকেলে জলকাদা পেরিয়ে বাড়ি বয়ে পড়াতে আসেন, উনারও স্ত্রীসন্তান আছে।

পাড়ার চায়ের দোকানের জয়জিত'দা তথাকথিত শিক্ষিত না হলেও, শিক্ষা বিষয়টা ঠিকই বোঝে। মাঝেমধ্যে ভূবন মাস্টারের পিঠ চাপড়ে বলেন, ভূবন, টিউশন করলেও তুমি শিক্ষক, তুমিও সমমর্যাদার অধীকারি। সমাজের এক মহান কর্তব্য তুমি পালন করছ। মনে রাখবে, শিক্ষাদান সবার জন্য নয়। তুমি একজনকে আলো দেখাচ্ছ, আমরা তো চোখ থাকতেও অন্ধ।

এই গল্পের আড়ালে যেমন ব্যতিক্রমী সত্যি লুকিয়ে আছে, তেমন সমাজে অনেক ব্যতিক্রমী সত্যিও আছে। সেগুলো আর নাইবা বললাম।
জানিস, এই সকালের সূর্যের কিরণ কেমন যেন টিউশনের স্যারের মত, শৈশবের অ-আ-ক-খ তো তাদেরই দীপ্তি, আমাদের বাকি জীবনকে আলোকিত করে।

Sudip Sen
12/Nov/15