অকাল গোধূলি
Tiyash Mukhopadhyay & Sudip Sen
শাক্য অপ্রকাশিত গল্পের লেখক। মাঝে মধ্যে চড়া দাম পেলে দু'একটা গল্প লেখে মাত্র। সেগুলো যে কোনও প্রকাশনা সংস্থায় কাগজের বই আকারে বিক্রি হয় তা নয়। হাতে লেখা গল্প। সে গল্পের এক জনই পাঠক, যে দাম দিয়ে কেনে। হ্যাঁ, এই অদ্ভূত গোত্রের 'লেখক' পরিচয়েই শাক্যর বেঁচে থাকা।
শাক্যর লেখার টেবিলের ও প্রান্তে তিতিরের ছবি। তিতির শাক্যর কাছে মানুষ রূপী দেবী। দেবী সরস্বতী। শাক্য যাই লেখে, তাতেই তিতির থাকে। কখনও তিতির লক্ষ্মী, শান্ত ঘরের মেয়েটি, তিতিরই কখনও উদ্দাম তরুণী, স্বাধীনতার মানে নিজের মতো করে বুঝে নেয়। আবার তিতিরই কখনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে গিয়ে অস্ত্র পর্যন্ত হাতে তুলে নেয়। কখনও বা তিতির প্রেমের জোয়ারে ভাসা নরম সবুজ পালতোলা নৌকাখানি, কখনও বা তিতির পরম মমতাময়ী মায়ের চেহারায় কোলের সন্তানকে স্তন্যপান করায়। তিতিরের ছবিই নানা রকম ভাবে আঁকে শাক্য। কোথাও চড়া রঙ, কোথাও বা রঙ নেই। কখনও বা চারকোল ঘষা, কখনও নিছক বাঁকা তুলির রেখা। আর এই প্রত্যেকটা ছবিই আলাদা আলাদা উপন্যাস হয়ে ওঠে শাক্যর লেখনীর গুণে। প্রতি বারই প্রকাশক বলেন, "এই একঘেয়েমি আর সস্তা চটকের যুগে লেখায় এত বৈচিত্র্য আপনি খুঁজে পান কী করে!"
শাক্য শুধু হাসে। ও জানে বৈচিত্র্য বলে কিছু নেই ওর লেখায়। সবই তিতিরের কথা। বৈচিত্র্য তো আসলে তিতিরের প্রিয় চাদরখানা, যেটা ও সব সময় গায়ে জড়িয়ে রাখে। না না, রাখত। আজ তিতির কী রাখে, কী ফেলে, কী করে....কিছুই জানে না শাক্য। তেরোটা বছর এই না-জানা নিয়েই আছে ও। অসুবিধা হয় না। এক দিকে ভালই, বাইশ বছরের তিতির এখনও ওর কাছে থেকে গিয়েছে ওর হয়ে। ওকে হাসায়, কাঁদায়, লেখায়। বৈচিত্র্যের জোগান দেয়। চলছে এ ভাবেই।
টেবিলের ও পারে একটা ছবি, আর এ পারে অনেক শব্দ-ঝড়।
রাতের নিস্তব্ধতায় শাক্যর কলমে অনুভূতিরা আসে, সঙ্গে উজান স্রোতের উত্তরী হাওয়া। শাক্যর বন্ধ জানলায় মাথা খোঁড়ে ওরা। শাক্য কখনও বা একটা পাল্লা খুলে দেয় নদীর দিকের জানলাটার। নদীর পাশে কবরখানা। ওখানে তিনটে শেয়াল দক্ষিণ দিকে মুখ করে ডাকছে। শাক্য জানালার পর্দা সরিয়ে দেখার চেষ্টা করে। কবরের পাশে কেউ যেন উবু হয়ে বসে আছে, ঝোড়ো হাওয়া ওর চুল ওড়াচ্ছে।
ওর চোখের অঝোর জল ভেজাচ্ছে একটা কবর। ছেলেটা একটা চাদর দিয়ে কবরটা চাপা দিচ্ছে। চাঁদের আবছা আলোতেও শাক্য বুঝতে পারে, নীলচে সবুজ রঙের চাদর। এটা তিতিরের প্রিয় রঙ ছিল। যখন তিতির গায়ে জড়িয়ে আসত ওকে বর্ষার ময়ূরির মত লাগতো। স্পর্শ পেতে ইচ্ছে করত তিতিরের। হারানোর ভয়ে নিজেকে ছিনিয়ে নিত নিজের কাছ থেকেই। ছেলেটা কবরের পাশে বসে এখনও কাঁদছে, ওর কান্নার মৃদু গুনগুন বাতাসের বেগের সঙ্গে গভীর বিরহের আবহ ভাসিয়ে দিচ্ছে। শাক্যরও ইচ্ছে করে, তিতিরের ছবিটা বুকে নিয়ে একটু কাঁদে। এই ছবি তো এখন কবরের মতোই। খুব ইচ্ছে করে শাক্যর, ওর চোখের জলে ভেসে যাক তিতিরের চোখ, গাল, ঠোঁট, চিবুকের তিল....কিন্তু গরম কয়লার মতো খটখটে শুকনো চোখে ছবিটা হাতে ধরে থাকে শাক্য। জল...সে যেন ছুটি নিয়েছে শাক্যর চোখ থেকে। এত উত্তাপ সহ্য হয়নি তার।
শাক্য কলম ডোবায় দোয়াতে। লিখে চলে, একটা কবরের গল্প। সেই কবরের নীচে ঘুমিয়ে আছে তিতির...না না গল্পের নামটা তিতির নয়, অন্য কিছু। আর কবরের পাশে বসে চোখের জল ফেলছে.....ওই ছেলেটার জায়গায় নিজেকে বসাতে খুব ইচ্ছে করছে শাক্যর। অনেক ভেবে চরিত্রের নাম দেয় গৌতম। সারা রাত ধরে লিখে ভোরের দিকে তন্দ্রা আসে শাক্যর। গল্পটা শেষ হয়নি। "...গৌতম নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। নীলচে সবুজ একটা চাদরের সঙ্গে একটা থান ইট বেঁধে চাদরের অন্য খুঁটটা নিজের পায়ে বেঁধে রেখেছে। শান বাঁধানো ঘাটে এক পা এগিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে রয়েছে গৌতম। পেছন থেকে কবরটা ওকে ডাকছে। বলছে আর একটু এগোলেই আমার পাশে ফিরতে পারবে তুমি। আমরা পরস্পরকে জড়িয়ে থাকতে পারব। যাও....গৌতম...যাও...আর একটু.. গৌতম নির্নিমেষে সূর্যোদয় দেখছে। ভাবছে, সে কবর খুঁজলে সূর্যটা রোজ সকালে কাকে খুঁজবে। এক পা-ও এগোয় না গৌতম। পেছোয়ও না। লালচে আকাশের পটভূমে একটা ঋজুদেহ সিল্যুট তৈরি করে। স্থির। শান্ত।..."
এই অবধি লিখে আর দোয়াতে কলম ডোবায় না শাক্য। ভাবে, এর পরের গল্পটা তার জানা নেই। পাঠকের জন্য থাক।
উঠে স্নান সেরে পোশাক বদলায় শাক্য। আজ বাজার না গেলেই নয়। ক্লান্ত দেহে ব্যাগ হাতে বেরোয় ঘরের বাইরে। দরজাটা শুধু টানা থাকে। ঘরে কখনও তালা দেয় না শাক্য। ওর কিছু হারানোর নেই। একটা ছবি আর ধূসর পাণ্ডুলিপিরা আর যা-ই হোক, চোর আসার কারণ হতে পারে না।
পাড়ার ঘোষবাবু, সেনবাবু, মুখার্জীবাবুদের সঙ্গে দেখা হয়। কারও সঙ্গেই তেমন কথাবার্তা নেই শাক্যর। একটু হাসি-বিনিময়েই সেরে নেয় আলাপচারিতা। তাঁদের কৌতূহলী দৃষ্টিরা অবশ্য শাক্যর পিছু নিয়েই সন্তুষ্ট হয় না, সে চোখের আড়ালে গেলেই ঘনায় আলোচনার সাইক্লোন। দেখতে শুনতে তো ভালই বেশ, বিপত্নীক নাকি অকৃতদার? করেন কী? লেখেন বলে তো শুনেছি, সে লেখা ছাপে কারা? বই কই?
বাজার সেরে ফিরে রান্না চড়ায় শাক্য। আয়োজন অতি সামান্য। ভাত-আলু-ডিম সেদ্ধ আর একটু ঘি-নুন। খেয়ে ঘুমোল শাক্য। স্বপ্ন এল ঘুমের মধ্যে। একটা বড় চারতলা বাড়ির নীচে ঝোলা কাঁধে দাঁড়িয়ে একটা বছর তেইশের ছেলে। দারোয়ান বলল, "দিদিমণি বলেছেন ওই নামের কাউকে চেনেন না। আপনাকে ভেতরে যেতে মানা করেছেন।" পথে পথে ঘুরল ছেলে। চোখ ঝাপসা, মনে অভিমান। ঘুমটা ভেঙে গেল শাক্যর। বালিশ ভিজেছে। জেগে থাকলে এই একটু জলের জন্য কত আকুতি থাকে শাক্যর, ঘুমের মধ্যে একটা বহুদূরের স্বপ্ন অনায়াসে সেই আকুতি পূরণ করে বালিশ ভেজায়।
জেগে উঠেও স্বপ্নের মতোই ছেঁড়া ছেঁড়া দৃশ্যরা উঁকি মারে শাক্যর মস্তিষ্কের আনাচে কানাচে। কলেজ স্ট্রিটের ফুটে হাঁটতে হাঁটতে তিতির বলছে...যদি কোনও দিন আমি মরেও যাই, তবু তোর লেখার মধ্যে দিয়ে আমায় বাঁচিয়ে রাখিস, তোর কাছে রাখিস।
গড়ের মাঠে খোলা চুল উড়িয়ে তিতির। দুহাত মেলে বলছে, তোকে ভুলে গেলেও তোর কলমকে ভুলব না শাক্য...তোর সব শব্দেরা যে আমারই সন্তান। আরও কত কত তিতিরের ছবি... কত কত মুহূর্ত... কত কত স্মৃতির টুকরো...
টিং টং!
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। আজ প্রকাশকবাবুর আসার কথা। প্রকাশক শব্দটাই অবশ্য নেহাত হাসির খোরাক। একটা কাঁচা পাণ্ডুলিপির একটি মাত্র কপি সযত্নে বিক্রি করেন তিনি। কাকে, কী ভাবে, কোথায়....কিছুই ফাঁস করেন না। শুধু এসে লেখা নিয়ে যান, মাসের নির্দিষ্ট তারিখে শাক্যর অ্যাকাউন্টে টাকা জমা পড়ে যায়। যতটা টাকায় একটা মানুষের ভাল ভাবে বেঁচে থাকা হয়।
সেই দিনটার কথা মনে পড়ে শাক্যর। বছর সাতেক আগে, যে দিন প্রথম দরজায় কড়া নেড়েছিলেন প্রকাশকবাবু। বর্ষার সন্ধে। আকাশ সেদিন উজাড় ছিল। আধভেজা লোকটা একটু উদভ্রান্তের মতো ঘরে ঢুকেছিলেন, কোনও ভনিতা ছাড়াই বলেছিলেন,
--নমস্কার, আমি সৌমাল্য। আপনার লেখা চাই। দেবেন?
--কিন্তু আমি তো লেখা ছাপাই না।
--ছাপাতে চাই না, পড়াতে চাই।
--আপনি কী ভাবে...আমি ঠিক...
--এক সময় তো ছাপাতেন, সেখান থেকেই অনেক কষ্টে আপনার ঠিকানা পেয়েছি।
--তা হলে তো এটাও জানেন, প্রায় বছর পাঁচেক আর লেখালেখি করি না আমি।
--লেখালেখি অবশ্যই করেন, প্রকাশ করেন না। সেই লেখাগুলো কি কারও পড়ার অধিকার নেই? এটা অন্যায়।
একটু রাগই হয়েছিল শাক্যর। এ আবার কী মগের মুলুক! বিরক্ত হয়েই বলেছিল, "আমার লেখা নিয়ে কী করব তাতে আপনার কী মশাই....ছাপাব না তো বলেইছি।"
তর্কটা অনেক ক্ষণ চলেছিল। সেই তর্ক থেকে আলোচনা হয়ে আড্ডায় গড়িয়েছিল। সৌমাল্য শাক্যকে কনভিন্স করিয়েছিল, শাক্যর এক জন ভক্ত এমন ধরেছেন, যার জোরাজুরিতে সৌমাল্য শাক্যর কাছে আসতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁর একটাই দাবি, মাঝে মাঝে শাক্যর লেখা জোগাড় করে দিতে হবে। আর সেই ভক্ত সৌমাল্যর খুব কাছের মানুষ, তাই ফেরানো যায়নি।
শেষে চুক্তি হয়েছিল, একটা নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে সৌমাল্য এসে শাক্যর লেখার একটা করে কপি নিয়ে যাবেন। বদলে পারিশ্রমিক পাবেন শাক্য। এই অদ্ভুত প্রস্তাবে অবাক হয়েও রাজি হয়েছিল শাক্য, কারণ ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট তখন শুকিয়ে এসেছে। ফুরিয়ে এসেছে সঞ্চয়। সামান্য নুন ভাতটুকুর জন্যও তো টাকার দরকার।
এভাবেই চলছে তার পর থেকে। সৌমাল্য আসেন, খানিক গল্প করেন, লেখা নেন, চলে যান। অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকে যায় শাক্যর। দিব্য চলছে। সাত বছর ধরে। একটাই ধোঁয়াশা রয়েছে শুধু, কে সেই ভক্ত, যার জন্য সৌমাল্য এত দাম দিয়ে পাণ্ডুলিপি কেনেন। প্রশ্নটা যত বারই শাক্য তোলার চেষ্টা করেছে, সৌমাল্য এড়িয়ে গিয়েছেন।
গত রাতে শেষ করা উপন্যাস এ দিন সৌমাল্যকে দিয়ে দিল শাক্য।
তিন দিনের মাথায় নিস্তব্ধ দুপুরে একটা চিঠি পেয়েছিল শাক্য। সম্বোধনহীন সে চিঠিতে একটাই বাক্য। "তুই কী করে বুঝেছিস রে কবরেই বেঁচে আছি আমি বড় অন্ধকার...তোর কাছে আলো আছে?"
বিকেল হয়নি এখনও, তাও রোদ মরে এসেছে। জানলার পাশে বসে নরম তাপে নিজেকে ভেজাচ্ছিল শাক্য। বহু দিন পর তিতিরের পুরনো চিঠিগুলো বাক্স থেকে বার করেছে। একটা একটা করে ভাঁজ খুলে পরখ করছে, গন্ধ শুঁকছে। অবধারিত ভাবে সামনে এল শেষ চিঠির খামটা। ভেতরে চিঠি ছাড়াও, একটা বিয়ের কার্ড। কোনও দিন কার্ডটা খুলে দেখেনি শাক্য, আজ দেখল। ঝাপসা শব্দগুলো পড়ার চেষ্টা করল। ... সুগত ও তনিমার একমাত্র সন্তান তিতিরের সঙ্গে জয়দীপ ও অন্তরার জ্যেষ্ঠ পুত্র সৌমাল্যর শুভ পরিণয়......
সব ধোঁয়াশা পেরিয়ে একটা অসীম শূন্যতার মাঝে বসে আছে শাক্য। ঘরের ভেতরটা কেমন হলদে আলোয় ভাসছে। সেই হলদে ছোঁয়ায় অভিমানের বরফ টুকরোগুলো গলছে...খুব ধীরে।...
Tiyash Mukhopadhyay & Sudip Sen
শাক্য অপ্রকাশিত গল্পের লেখক। মাঝে মধ্যে চড়া দাম পেলে দু'একটা গল্প লেখে মাত্র। সেগুলো যে কোনও প্রকাশনা সংস্থায় কাগজের বই আকারে বিক্রি হয় তা নয়। হাতে লেখা গল্প। সে গল্পের এক জনই পাঠক, যে দাম দিয়ে কেনে। হ্যাঁ, এই অদ্ভূত গোত্রের 'লেখক' পরিচয়েই শাক্যর বেঁচে থাকা।
শাক্যর লেখার টেবিলের ও প্রান্তে তিতিরের ছবি। তিতির শাক্যর কাছে মানুষ রূপী দেবী। দেবী সরস্বতী। শাক্য যাই লেখে, তাতেই তিতির থাকে। কখনও তিতির লক্ষ্মী, শান্ত ঘরের মেয়েটি, তিতিরই কখনও উদ্দাম তরুণী, স্বাধীনতার মানে নিজের মতো করে বুঝে নেয়। আবার তিতিরই কখনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে গিয়ে অস্ত্র পর্যন্ত হাতে তুলে নেয়। কখনও বা তিতির প্রেমের জোয়ারে ভাসা নরম সবুজ পালতোলা নৌকাখানি, কখনও বা তিতির পরম মমতাময়ী মায়ের চেহারায় কোলের সন্তানকে স্তন্যপান করায়। তিতিরের ছবিই নানা রকম ভাবে আঁকে শাক্য। কোথাও চড়া রঙ, কোথাও বা রঙ নেই। কখনও বা চারকোল ঘষা, কখনও নিছক বাঁকা তুলির রেখা। আর এই প্রত্যেকটা ছবিই আলাদা আলাদা উপন্যাস হয়ে ওঠে শাক্যর লেখনীর গুণে। প্রতি বারই প্রকাশক বলেন, "এই একঘেয়েমি আর সস্তা চটকের যুগে লেখায় এত বৈচিত্র্য আপনি খুঁজে পান কী করে!"
শাক্য শুধু হাসে। ও জানে বৈচিত্র্য বলে কিছু নেই ওর লেখায়। সবই তিতিরের কথা। বৈচিত্র্য তো আসলে তিতিরের প্রিয় চাদরখানা, যেটা ও সব সময় গায়ে জড়িয়ে রাখে। না না, রাখত। আজ তিতির কী রাখে, কী ফেলে, কী করে....কিছুই জানে না শাক্য। তেরোটা বছর এই না-জানা নিয়েই আছে ও। অসুবিধা হয় না। এক দিকে ভালই, বাইশ বছরের তিতির এখনও ওর কাছে থেকে গিয়েছে ওর হয়ে। ওকে হাসায়, কাঁদায়, লেখায়। বৈচিত্র্যের জোগান দেয়। চলছে এ ভাবেই।
টেবিলের ও পারে একটা ছবি, আর এ পারে অনেক শব্দ-ঝড়।
রাতের নিস্তব্ধতায় শাক্যর কলমে অনুভূতিরা আসে, সঙ্গে উজান স্রোতের উত্তরী হাওয়া। শাক্যর বন্ধ জানলায় মাথা খোঁড়ে ওরা। শাক্য কখনও বা একটা পাল্লা খুলে দেয় নদীর দিকের জানলাটার। নদীর পাশে কবরখানা। ওখানে তিনটে শেয়াল দক্ষিণ দিকে মুখ করে ডাকছে। শাক্য জানালার পর্দা সরিয়ে দেখার চেষ্টা করে। কবরের পাশে কেউ যেন উবু হয়ে বসে আছে, ঝোড়ো হাওয়া ওর চুল ওড়াচ্ছে।
ওর চোখের অঝোর জল ভেজাচ্ছে একটা কবর। ছেলেটা একটা চাদর দিয়ে কবরটা চাপা দিচ্ছে। চাঁদের আবছা আলোতেও শাক্য বুঝতে পারে, নীলচে সবুজ রঙের চাদর। এটা তিতিরের প্রিয় রঙ ছিল। যখন তিতির গায়ে জড়িয়ে আসত ওকে বর্ষার ময়ূরির মত লাগতো। স্পর্শ পেতে ইচ্ছে করত তিতিরের। হারানোর ভয়ে নিজেকে ছিনিয়ে নিত নিজের কাছ থেকেই। ছেলেটা কবরের পাশে বসে এখনও কাঁদছে, ওর কান্নার মৃদু গুনগুন বাতাসের বেগের সঙ্গে গভীর বিরহের আবহ ভাসিয়ে দিচ্ছে। শাক্যরও ইচ্ছে করে, তিতিরের ছবিটা বুকে নিয়ে একটু কাঁদে। এই ছবি তো এখন কবরের মতোই। খুব ইচ্ছে করে শাক্যর, ওর চোখের জলে ভেসে যাক তিতিরের চোখ, গাল, ঠোঁট, চিবুকের তিল....কিন্তু গরম কয়লার মতো খটখটে শুকনো চোখে ছবিটা হাতে ধরে থাকে শাক্য। জল...সে যেন ছুটি নিয়েছে শাক্যর চোখ থেকে। এত উত্তাপ সহ্য হয়নি তার।
শাক্য কলম ডোবায় দোয়াতে। লিখে চলে, একটা কবরের গল্প। সেই কবরের নীচে ঘুমিয়ে আছে তিতির...না না গল্পের নামটা তিতির নয়, অন্য কিছু। আর কবরের পাশে বসে চোখের জল ফেলছে.....ওই ছেলেটার জায়গায় নিজেকে বসাতে খুব ইচ্ছে করছে শাক্যর। অনেক ভেবে চরিত্রের নাম দেয় গৌতম। সারা রাত ধরে লিখে ভোরের দিকে তন্দ্রা আসে শাক্যর। গল্পটা শেষ হয়নি। "...গৌতম নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। নীলচে সবুজ একটা চাদরের সঙ্গে একটা থান ইট বেঁধে চাদরের অন্য খুঁটটা নিজের পায়ে বেঁধে রেখেছে। শান বাঁধানো ঘাটে এক পা এগিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে রয়েছে গৌতম। পেছন থেকে কবরটা ওকে ডাকছে। বলছে আর একটু এগোলেই আমার পাশে ফিরতে পারবে তুমি। আমরা পরস্পরকে জড়িয়ে থাকতে পারব। যাও....গৌতম...যাও...আর একটু.. গৌতম নির্নিমেষে সূর্যোদয় দেখছে। ভাবছে, সে কবর খুঁজলে সূর্যটা রোজ সকালে কাকে খুঁজবে। এক পা-ও এগোয় না গৌতম। পেছোয়ও না। লালচে আকাশের পটভূমে একটা ঋজুদেহ সিল্যুট তৈরি করে। স্থির। শান্ত।..."
এই অবধি লিখে আর দোয়াতে কলম ডোবায় না শাক্য। ভাবে, এর পরের গল্পটা তার জানা নেই। পাঠকের জন্য থাক।
উঠে স্নান সেরে পোশাক বদলায় শাক্য। আজ বাজার না গেলেই নয়। ক্লান্ত দেহে ব্যাগ হাতে বেরোয় ঘরের বাইরে। দরজাটা শুধু টানা থাকে। ঘরে কখনও তালা দেয় না শাক্য। ওর কিছু হারানোর নেই। একটা ছবি আর ধূসর পাণ্ডুলিপিরা আর যা-ই হোক, চোর আসার কারণ হতে পারে না।
পাড়ার ঘোষবাবু, সেনবাবু, মুখার্জীবাবুদের সঙ্গে দেখা হয়। কারও সঙ্গেই তেমন কথাবার্তা নেই শাক্যর। একটু হাসি-বিনিময়েই সেরে নেয় আলাপচারিতা। তাঁদের কৌতূহলী দৃষ্টিরা অবশ্য শাক্যর পিছু নিয়েই সন্তুষ্ট হয় না, সে চোখের আড়ালে গেলেই ঘনায় আলোচনার সাইক্লোন। দেখতে শুনতে তো ভালই বেশ, বিপত্নীক নাকি অকৃতদার? করেন কী? লেখেন বলে তো শুনেছি, সে লেখা ছাপে কারা? বই কই?
বাজার সেরে ফিরে রান্না চড়ায় শাক্য। আয়োজন অতি সামান্য। ভাত-আলু-ডিম সেদ্ধ আর একটু ঘি-নুন। খেয়ে ঘুমোল শাক্য। স্বপ্ন এল ঘুমের মধ্যে। একটা বড় চারতলা বাড়ির নীচে ঝোলা কাঁধে দাঁড়িয়ে একটা বছর তেইশের ছেলে। দারোয়ান বলল, "দিদিমণি বলেছেন ওই নামের কাউকে চেনেন না। আপনাকে ভেতরে যেতে মানা করেছেন।" পথে পথে ঘুরল ছেলে। চোখ ঝাপসা, মনে অভিমান। ঘুমটা ভেঙে গেল শাক্যর। বালিশ ভিজেছে। জেগে থাকলে এই একটু জলের জন্য কত আকুতি থাকে শাক্যর, ঘুমের মধ্যে একটা বহুদূরের স্বপ্ন অনায়াসে সেই আকুতি পূরণ করে বালিশ ভেজায়।
জেগে উঠেও স্বপ্নের মতোই ছেঁড়া ছেঁড়া দৃশ্যরা উঁকি মারে শাক্যর মস্তিষ্কের আনাচে কানাচে। কলেজ স্ট্রিটের ফুটে হাঁটতে হাঁটতে তিতির বলছে...যদি কোনও দিন আমি মরেও যাই, তবু তোর লেখার মধ্যে দিয়ে আমায় বাঁচিয়ে রাখিস, তোর কাছে রাখিস।
গড়ের মাঠে খোলা চুল উড়িয়ে তিতির। দুহাত মেলে বলছে, তোকে ভুলে গেলেও তোর কলমকে ভুলব না শাক্য...তোর সব শব্দেরা যে আমারই সন্তান। আরও কত কত তিতিরের ছবি... কত কত মুহূর্ত... কত কত স্মৃতির টুকরো...
টিং টং!
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। আজ প্রকাশকবাবুর আসার কথা। প্রকাশক শব্দটাই অবশ্য নেহাত হাসির খোরাক। একটা কাঁচা পাণ্ডুলিপির একটি মাত্র কপি সযত্নে বিক্রি করেন তিনি। কাকে, কী ভাবে, কোথায়....কিছুই ফাঁস করেন না। শুধু এসে লেখা নিয়ে যান, মাসের নির্দিষ্ট তারিখে শাক্যর অ্যাকাউন্টে টাকা জমা পড়ে যায়। যতটা টাকায় একটা মানুষের ভাল ভাবে বেঁচে থাকা হয়।
সেই দিনটার কথা মনে পড়ে শাক্যর। বছর সাতেক আগে, যে দিন প্রথম দরজায় কড়া নেড়েছিলেন প্রকাশকবাবু। বর্ষার সন্ধে। আকাশ সেদিন উজাড় ছিল। আধভেজা লোকটা একটু উদভ্রান্তের মতো ঘরে ঢুকেছিলেন, কোনও ভনিতা ছাড়াই বলেছিলেন,
--নমস্কার, আমি সৌমাল্য। আপনার লেখা চাই। দেবেন?
--কিন্তু আমি তো লেখা ছাপাই না।
--ছাপাতে চাই না, পড়াতে চাই।
--আপনি কী ভাবে...আমি ঠিক...
--এক সময় তো ছাপাতেন, সেখান থেকেই অনেক কষ্টে আপনার ঠিকানা পেয়েছি।
--তা হলে তো এটাও জানেন, প্রায় বছর পাঁচেক আর লেখালেখি করি না আমি।
--লেখালেখি অবশ্যই করেন, প্রকাশ করেন না। সেই লেখাগুলো কি কারও পড়ার অধিকার নেই? এটা অন্যায়।
একটু রাগই হয়েছিল শাক্যর। এ আবার কী মগের মুলুক! বিরক্ত হয়েই বলেছিল, "আমার লেখা নিয়ে কী করব তাতে আপনার কী মশাই....ছাপাব না তো বলেইছি।"
তর্কটা অনেক ক্ষণ চলেছিল। সেই তর্ক থেকে আলোচনা হয়ে আড্ডায় গড়িয়েছিল। সৌমাল্য শাক্যকে কনভিন্স করিয়েছিল, শাক্যর এক জন ভক্ত এমন ধরেছেন, যার জোরাজুরিতে সৌমাল্য শাক্যর কাছে আসতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁর একটাই দাবি, মাঝে মাঝে শাক্যর লেখা জোগাড় করে দিতে হবে। আর সেই ভক্ত সৌমাল্যর খুব কাছের মানুষ, তাই ফেরানো যায়নি।
শেষে চুক্তি হয়েছিল, একটা নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে সৌমাল্য এসে শাক্যর লেখার একটা করে কপি নিয়ে যাবেন। বদলে পারিশ্রমিক পাবেন শাক্য। এই অদ্ভুত প্রস্তাবে অবাক হয়েও রাজি হয়েছিল শাক্য, কারণ ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট তখন শুকিয়ে এসেছে। ফুরিয়ে এসেছে সঞ্চয়। সামান্য নুন ভাতটুকুর জন্যও তো টাকার দরকার।
এভাবেই চলছে তার পর থেকে। সৌমাল্য আসেন, খানিক গল্প করেন, লেখা নেন, চলে যান। অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকে যায় শাক্যর। দিব্য চলছে। সাত বছর ধরে। একটাই ধোঁয়াশা রয়েছে শুধু, কে সেই ভক্ত, যার জন্য সৌমাল্য এত দাম দিয়ে পাণ্ডুলিপি কেনেন। প্রশ্নটা যত বারই শাক্য তোলার চেষ্টা করেছে, সৌমাল্য এড়িয়ে গিয়েছেন।
গত রাতে শেষ করা উপন্যাস এ দিন সৌমাল্যকে দিয়ে দিল শাক্য।
তিন দিনের মাথায় নিস্তব্ধ দুপুরে একটা চিঠি পেয়েছিল শাক্য। সম্বোধনহীন সে চিঠিতে একটাই বাক্য। "তুই কী করে বুঝেছিস রে কবরেই বেঁচে আছি আমি বড় অন্ধকার...তোর কাছে আলো আছে?"
বিকেল হয়নি এখনও, তাও রোদ মরে এসেছে। জানলার পাশে বসে নরম তাপে নিজেকে ভেজাচ্ছিল শাক্য। বহু দিন পর তিতিরের পুরনো চিঠিগুলো বাক্স থেকে বার করেছে। একটা একটা করে ভাঁজ খুলে পরখ করছে, গন্ধ শুঁকছে। অবধারিত ভাবে সামনে এল শেষ চিঠির খামটা। ভেতরে চিঠি ছাড়াও, একটা বিয়ের কার্ড। কোনও দিন কার্ডটা খুলে দেখেনি শাক্য, আজ দেখল। ঝাপসা শব্দগুলো পড়ার চেষ্টা করল। ... সুগত ও তনিমার একমাত্র সন্তান তিতিরের সঙ্গে জয়দীপ ও অন্তরার জ্যেষ্ঠ পুত্র সৌমাল্যর শুভ পরিণয়......
সব ধোঁয়াশা পেরিয়ে একটা অসীম শূন্যতার মাঝে বসে আছে শাক্য। ঘরের ভেতরটা কেমন হলদে আলোয় ভাসছে। সেই হলদে ছোঁয়ায় অভিমানের বরফ টুকরোগুলো গলছে...খুব ধীরে।...
0 Comments
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন