ঊষা দিদার প্রতি আমার বরাবর রাগ। সেই ক্লাস টু-থেকে আমায় বর বর বলে ডাকে। এত কালো দেখতে যে দূর থেকে স্পষ্ট মুখটাও ঠিকঠাক বোঝা যায়না। সে কিভাবে আমার বৌ হতে পারে? শুধু তাই নয়, রোজ আমরা যখন ক্রিকেট খেলার জন্য মাঠে যেতাম, দেখতাম শুখনো লঙ্কা ঝাড়ছে। লঙ্কা গুলো থেকে বীজ আলাদা করার পর সেগুলো শিবু কাকার কলে ভাঙানে হতো। শিবুকাকা লঙ্কার গুড়ো বেচতেন আর বীজ গুলো আলাদা বিক্রি করতেন। ঊষাদিদা রোজ একটা টকটকে লাল রঙের শাড়ি পরতো, ঠোঁট পান খেয়ে সবসময় লাল হয়ে থাকতো, মাঝে মধ্যে নস্যিও নিত। খেলার সময় প্রায়-ই লঙ্কার ঝাঁজে  আমাদের কাশি হতো, তখন মনে হতো ঊষা দিদাকে বল ছুরে মারি। শান্তি করে খেলতেও দেবে না!

ঊষা দিদা প্রচন্ড ব্যস্ততার মধ্যে দিন কাটাতো। সক্কাল হলেই ধানের ভাটিতে গিয়ে ধান ভাপাতো, তারপর শানের মেঝেতে পায়ে করে নেড়ে নেড়ে ধান শুখাত। এক-একদিন বৃষ্টি হলে ঊষা দিদার কষ্ট দেখতাম। নিজে হাতে সব ধান এক জাগায় জড় করে চটের বস্তায় ভরতো। সম্ভবত বুদ্ধদেব দাদুর ছেঁড়া একটা জামা পরতো আর রোদের হাত থেকে রক্ষা পেতে আরেকটা জামা দিয়ে মাথায় ফেটি বাঁধতো। যেদিন ঝড় উঠতো, দিদার ছেঁড়া জামা অসহায় পাখির ডানার মতো ঝটপট করতো। চোখে মুখে ধুলো এসে পড়ত। চোখ দিয়ে জল বেড়োত। সে জল কান্নার নয়, নিতান্তই ধূলিকণার।
দিদার অসহায় অবস্থা দেখে আমারই কান্না পেত। কিন্তু দিদাকে কোনওদিন কাঁদতে দেখিনি।

দুপুরে ধান ভাপানোর কাজ শেষ হলে দিদা শিবু কাকার লঙ্কা ঝাড়তো, সন্ধ্যাতে বাড়ি ফিরে অন্যের কাঁথা শিলাই করতো, তা থেকেও বেশ আয় হতো।
অথচ রোজ এক জামা পরে ধানের ভাটিতে আর এক শাড়িতে শিবুকাকার লঙ্কা ঝাড়তে আসতো।
হাতের কুলো এক শৈল্পিক ছন্দময় গতিতে উপর নীচ করতো। এইভাবে কুলো নাড়ে আর দিন ফুঁড়ায়।

ক্লাস টুয়েলভ এ উঠে প্রত্যক্ষ করি ঊষা দিদা আমায় আর বর বলে ডাকছে না। এমনই এক অপ্রত্যাশিত বিকেলে দেখি লাল রঙের শাড়িটা সাদা হয়ে গিয়েছে। পরে জানতে পারলাম শরীরের সব রঙ বুদ্ধদেব দাদু স্বার্থপরের মত কেড়ে নিয়ে বিদায় নিয়েছে। সেদিন খেলতে খেলতে নাকে লঙ্কার ঝাঁজ আসছিল, কিন্তু একবারও মনে হয়নি বল ছুরে ঊষা দিদার পিঠে মারি।
পরের বছর কানে এলো, ঊষা দিদার একমাত্র ছেলে বাপি মামা মারা গিয়েছে। দেখতে গিয়েছিলাম, সেদিন বেশ কিছুটা অবাক হয়েছিলাম। ঊষাদিদা কি পাষাণ? ছেলের মৃত্যুর পরও চোখের জল নেই। নাকি সব চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছে?
কয়েকদিন পরেই দেখি ঊষা দিদা একনাগাড়ে কুলো নারাচ্ছে।

চারিদিকে কেমন পরিবর্তনের ছোঁয়া। আকাশে বাতাসে সর্বদা নতুন কিছুর হাতছানি। ঊষা দিদার সেই ক্লাস টুয়ের বরটাও আঁকার, আয়তন, বুদ্ধি বা ব্যক্তিত্ব সবেতেই বেড়েছে। অথচ গতকাল বিকেলে সন্ধ্যার সূর্য যখন দিনের সমস্ত আলো নিয়ে অস্ত যেতে চলেছে, আমি হিসেব করছিলাম জীবনের এই চব্বিশটা বছরে কী পেলাম আর কী হারালাম?
হঠাৎ চোখ যায় একটা ক্লান্ত ছায়ার দিকে, অবাক হয়েছিলাম.....
এই মানুষটাকে ক্লাস টু থেকে দেখছি, আজও অপরিবর্তিত রয়েছে, এক নাগারে, এক ছন্দে, বিরামহীন ভাবে কুলো নারাচ্ছে। সত্যিই, কিছুক্ষণের জন্য ফ্ল্যাশব্যাক এ সময়কে থমকে যেতে দেখেছিলাম।