#এক_এ_পক্ষ
পৃথা কোনওদিনই পার্থকে মনের কথা জানাতে পারেনি। প্রতিবারই বলার চেষ্টা করেছে অথচ শেষপর্যন্ত থমকে গিয়েছে। তাই প্রতিবার দুর থেকে পার্থকে দেখে, আর দুর থেকেই ভালোবাসে।
নিজের ফর্সা গাল, লম্বা কালো চুল, সুদীর্ঘ নাক, ধনুকাকৃতি বাঁকা ঠোঁট, ঠোঁটের নীচের তিল সবই ভাল লাগে পৃথার, কিন্তু ঠোঁটের পাশে কালো জন্মগত জরুলটা কিছুতেই ভাল লাগে না।
রোজ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে পূর্বেকার কোন পাপের জন্য ভগবান তাকে এই জঘন্য শাস্তি দিয়েছে!
ভালোবাসা শুধুমাত্র একটা রাতের নয়, কখনও সখনও জীবনের ষাটটা বছর একটা মানুষকে ভালোবেসে কাটিয়ে দেওয়া যায় প্রথম প্রেমের মেজাজে। সেই ক্লাস টুয়েলভ্ এ পার্থর সাথে প্রথম দেখা পৃথার, এখন কলেজে পার্টটাইম পড়ায়, অথচ অনুভূতিপ্রবণ মনের কোনো পরিবর্তন হয়নি পৃথার। আজও পার্থকে দেখলে বুক ঢিপঢিপ করে, ভয়মিশ্রিত অজ্ঞাত ভালোলাগা কাজ করে পৃথার মনে। কিন্তু পার্থ কী কখনও ভেবেছে পৃথাকে নিয়ে?
লঘু মুহূর্তে পার্থ আর প্রতিভাকে একসাথে দেখেছে পৃথা। দেখেছে স্কুলের ক্লাসে দুজনকে দুজনের দিকে তাকিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতে, দেখেছে বৃষ্টির দুপুরে এক ছাতার তলায় দুজনকে হাত ধরে রাস্তা পার হতে। দেখেছে সন্ধ্যার অন্ধকারে বটগাছের নীচে একাত্ম হতে, স্পর্শ করতে, ঠোঁটে ঠোঁট রাখতে। সেদিনের জ্যোৎস্নাময় রাতের নিস্তব্ধতাই মন ম্লান হয়ে এসেছিল পৃথার, একাত্ম হয়েছিল একাকিত্বের সাথে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিল, চেয়েছিল ঠোঁটের পাশের জরুলটা ব্লেডে করে কেটে বাদ দিতে। পারেনি।
পারেনি কলেজের মাঠে পার্থর পাশে প্রতিভার জাগায় নিজেকে দেখতে, পারেনি নিজের কোলে পার্থর মাথা রেখে ওর চুলে হাত বোলাতে। অথচ মাঝে মধ্যেই কচুপাতাই জল দাঁড়ায়, কিছুক্ষণ উজ্জ্বলতাযুক্ত দ্যুতির পর আবার ঝোড়ে পরে মাটিতে, এভাবেই পৃথার মনে পার্থ আসে। অনেকবার পৃথা মনকে জিজ্ঞেস করেছে কেন এ মিছে স্মৃতি? কেন এ পিছুটান? উত্তর পায়নি। শুধু মনে হয়েছে আত্মত্যাগ ব্যাতীত জীবনে প্রেম নেই।
পার্থর সাথে গতকাল বিকেলে দেখা হয়েছিল পৃথার। চেহারার সেই চমক আর নেই, এলোমেলো চুল, মুখভরা গোঁফদাড়ি, গাল বসা, ঠোঁটে কালসিটে দাগ পড়েছে, চোখের সেই দীপ্তিও আর নেই। স্কুটার থামিয়ে জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিল পার্থকে কেমন আছে.....পারেনি। পার্থকে দেখলে মন থেকে সব কথা ছুটি নেয়। ভাষা হারিয়ে ফেলে।
আচ্ছা! প্রতিভা কী আজও পার্থকে ভালোবাসে? নাকি পার্থ এখন অন্য প্রতিভার রহস্যান্মোচনে ব্যস্ত? ওকে তাহলে এত শুষ্ক এলোমেলো দেখালো কেন? নিজের প্রতি পার্থ আজকাল আর একদম খেয়াল রাখেনা বোধহয়। তাহলে কী একবার জানার চেষ্টা করবে পার্থ কেমন আছে?
পৃথা মেঝেতে বসে ঘড়ির কাটার চলন নিরীক্ষণ করতে থাকে। টিকটিক করে আওয়াজ করে এগিয়ে যাচ্ছে, এযেন এক ক্লান্তিহীন একটানা অবিরাম যাত্রা। তিনটে কাটার কেন্দ্রবিন্দু এক। অথচ বিস্তার আর ব্যাপ্তি ভিন্ন। মানুষের জীবনটাও অনেকটা একই রকম। শেষ সময়ে সকলের মিলন হয়। পাশের বাড়ি থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত ভেসে আসছে
"হায় মাঝে হল ছাড়াছাড়ি, গেলেম কে কোথায় আবার দেখা যদি হল, সখা, প্রাণের মাঝে আয়॥"
কলেজে পড়াতে মন্দ লাগেনা পৃথার। চেয়ারে বসে যখন রাধা বিরহের পর্ব বোঝায়, ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরা ওর দিকে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে। কেউ কেউ প্রথম বেঞ্চে বসে শাড়ির ভাঁজের দিকে নজর দেয়। কেউ ব্লাউজের দিকে চেয়ে এক অস্পষ্ট দাগ খোঁজে। কেউ আবার হাল্কা লোমের আচ্ছাদনে অনাবৃত উদর দেখার বৃথা চেষ্টা করে। সব-ই বুঝতে পারে পৃথা, অথচ কোনও দিন কাওকে কিছুই বলেনি। চোখ দিয়ে নারীসৌন্দর্য ভোগে কোনও অপরাধ দেখেনা পৃথা। একসময়ে এভাবেই ও পার্থর প্রতি চেয়ে থাকত। টকটকে লাল ঠোঁট, চায়ে ভেজা বিস্কুটের মতো পার্থর কান, দীপ্তিময় চোখ, আর শিশুর মত পবিত্র মন। নাহ্! আর দেরি নয়! অবিলম্বে পার্থর খোঁজ নেওয়া দরকার....প্রতিভা কী এখনও আছে ওর সাথে!
শহরের অন্ধকার সর্বদা নিগূঢ়। জোনাকি বা ঝিঁঝিঁপোকার ডাক কোনটার অস্তিত্ব নেই। আছে কলকারখানার অস্থির আওয়াজ। আছে রাস্তার পাশে জমেথাকা জল, মনের ভিতরের জমে থাকা ভালোবাসা, প্রত্যাখ্যানের ভয়, আর ঠোঁটের পাশের জন্মগত জরুল। আজ কী বলতে পারবে পার্থকে ওর ভালোবাসার কথা! নাকি পার্থ প্রতিভার সাথে সুখে আছে! কিংবা অন্যকারও সাথে!
বাড়ির ভিতরে ঢুকে অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে যায় পৃথা। টেবিলের একপ্রান্তে অসংখ্য টিকটিকি জড়ো করা।
সেগুলো লেজ কেটে পার্থ মুখে নিয়ে চিবোচ্ছে, একএকটা টিকটিকি ছটফট করতে করতে মরে যাচ্ছে। গোটা ঘরময় পচা গন্ধ। কিচ্ছু বুঝতে না পেরে বিনা বাক্যব্যয় করে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই পৃথা। অনিশ্চয়তার বেড়াজাল টপকে হঠাৎ-ই দেখা হয় পার্থর বাবা মার সাথে। জানা গেল গতবছর প্রতিভা চাকরির কারণে ব্যাঙ্গালোর যায়। দেখানে অফিসের বস এর সাথে বিয়েও হয়ে যায়। প্রাথমিকভাবে নিজেকে সামলাতে পারলেও দিনে দিনে ভেঙে পরে পার্থ। বেশ কয়েকবার মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয়েছেন তারা। এসময়ে পার্থর পাশে কেউ একজন থাকা অত্যন্ত জরুরি। পৃথা কিছুক্ষণের জন্য স্তম্ভিত হয়ে যায়। কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় ভাবতে থাকে কী করা উচিত..... অথচ মন থেকে কোনও উত্তর আসেনা।
ঘড়িতে ঘন্টা বাজলো, রাত বারোটা। তিনটে কাটা এক জাগায় দাঁড়িয়ে। চারিদিকে নির্জন নিস্তব্ধ অন্ধকার।
© Sudip Sen
14/Oct/15
পৃথা কোনওদিনই পার্থকে মনের কথা জানাতে পারেনি। প্রতিবারই বলার চেষ্টা করেছে অথচ শেষপর্যন্ত থমকে গিয়েছে। তাই প্রতিবার দুর থেকে পার্থকে দেখে, আর দুর থেকেই ভালোবাসে।
নিজের ফর্সা গাল, লম্বা কালো চুল, সুদীর্ঘ নাক, ধনুকাকৃতি বাঁকা ঠোঁট, ঠোঁটের নীচের তিল সবই ভাল লাগে পৃথার, কিন্তু ঠোঁটের পাশে কালো জন্মগত জরুলটা কিছুতেই ভাল লাগে না।
রোজ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে পূর্বেকার কোন পাপের জন্য ভগবান তাকে এই জঘন্য শাস্তি দিয়েছে!
ভালোবাসা শুধুমাত্র একটা রাতের নয়, কখনও সখনও জীবনের ষাটটা বছর একটা মানুষকে ভালোবেসে কাটিয়ে দেওয়া যায় প্রথম প্রেমের মেজাজে। সেই ক্লাস টুয়েলভ্ এ পার্থর সাথে প্রথম দেখা পৃথার, এখন কলেজে পার্টটাইম পড়ায়, অথচ অনুভূতিপ্রবণ মনের কোনো পরিবর্তন হয়নি পৃথার। আজও পার্থকে দেখলে বুক ঢিপঢিপ করে, ভয়মিশ্রিত অজ্ঞাত ভালোলাগা কাজ করে পৃথার মনে। কিন্তু পার্থ কী কখনও ভেবেছে পৃথাকে নিয়ে?
লঘু মুহূর্তে পার্থ আর প্রতিভাকে একসাথে দেখেছে পৃথা। দেখেছে স্কুলের ক্লাসে দুজনকে দুজনের দিকে তাকিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতে, দেখেছে বৃষ্টির দুপুরে এক ছাতার তলায় দুজনকে হাত ধরে রাস্তা পার হতে। দেখেছে সন্ধ্যার অন্ধকারে বটগাছের নীচে একাত্ম হতে, স্পর্শ করতে, ঠোঁটে ঠোঁট রাখতে। সেদিনের জ্যোৎস্নাময় রাতের নিস্তব্ধতাই মন ম্লান হয়ে এসেছিল পৃথার, একাত্ম হয়েছিল একাকিত্বের সাথে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিল, চেয়েছিল ঠোঁটের পাশের জরুলটা ব্লেডে করে কেটে বাদ দিতে। পারেনি।
পারেনি কলেজের মাঠে পার্থর পাশে প্রতিভার জাগায় নিজেকে দেখতে, পারেনি নিজের কোলে পার্থর মাথা রেখে ওর চুলে হাত বোলাতে। অথচ মাঝে মধ্যেই কচুপাতাই জল দাঁড়ায়, কিছুক্ষণ উজ্জ্বলতাযুক্ত দ্যুতির পর আবার ঝোড়ে পরে মাটিতে, এভাবেই পৃথার মনে পার্থ আসে। অনেকবার পৃথা মনকে জিজ্ঞেস করেছে কেন এ মিছে স্মৃতি? কেন এ পিছুটান? উত্তর পায়নি। শুধু মনে হয়েছে আত্মত্যাগ ব্যাতীত জীবনে প্রেম নেই।
পার্থর সাথে গতকাল বিকেলে দেখা হয়েছিল পৃথার। চেহারার সেই চমক আর নেই, এলোমেলো চুল, মুখভরা গোঁফদাড়ি, গাল বসা, ঠোঁটে কালসিটে দাগ পড়েছে, চোখের সেই দীপ্তিও আর নেই। স্কুটার থামিয়ে জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিল পার্থকে কেমন আছে.....পারেনি। পার্থকে দেখলে মন থেকে সব কথা ছুটি নেয়। ভাষা হারিয়ে ফেলে।
আচ্ছা! প্রতিভা কী আজও পার্থকে ভালোবাসে? নাকি পার্থ এখন অন্য প্রতিভার রহস্যান্মোচনে ব্যস্ত? ওকে তাহলে এত শুষ্ক এলোমেলো দেখালো কেন? নিজের প্রতি পার্থ আজকাল আর একদম খেয়াল রাখেনা বোধহয়। তাহলে কী একবার জানার চেষ্টা করবে পার্থ কেমন আছে?
পৃথা মেঝেতে বসে ঘড়ির কাটার চলন নিরীক্ষণ করতে থাকে। টিকটিক করে আওয়াজ করে এগিয়ে যাচ্ছে, এযেন এক ক্লান্তিহীন একটানা অবিরাম যাত্রা। তিনটে কাটার কেন্দ্রবিন্দু এক। অথচ বিস্তার আর ব্যাপ্তি ভিন্ন। মানুষের জীবনটাও অনেকটা একই রকম। শেষ সময়ে সকলের মিলন হয়। পাশের বাড়ি থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত ভেসে আসছে
"হায় মাঝে হল ছাড়াছাড়ি, গেলেম কে কোথায় আবার দেখা যদি হল, সখা, প্রাণের মাঝে আয়॥"
কলেজে পড়াতে মন্দ লাগেনা পৃথার। চেয়ারে বসে যখন রাধা বিরহের পর্ব বোঝায়, ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরা ওর দিকে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে। কেউ কেউ প্রথম বেঞ্চে বসে শাড়ির ভাঁজের দিকে নজর দেয়। কেউ ব্লাউজের দিকে চেয়ে এক অস্পষ্ট দাগ খোঁজে। কেউ আবার হাল্কা লোমের আচ্ছাদনে অনাবৃত উদর দেখার বৃথা চেষ্টা করে। সব-ই বুঝতে পারে পৃথা, অথচ কোনও দিন কাওকে কিছুই বলেনি। চোখ দিয়ে নারীসৌন্দর্য ভোগে কোনও অপরাধ দেখেনা পৃথা। একসময়ে এভাবেই ও পার্থর প্রতি চেয়ে থাকত। টকটকে লাল ঠোঁট, চায়ে ভেজা বিস্কুটের মতো পার্থর কান, দীপ্তিময় চোখ, আর শিশুর মত পবিত্র মন। নাহ্! আর দেরি নয়! অবিলম্বে পার্থর খোঁজ নেওয়া দরকার....প্রতিভা কী এখনও আছে ওর সাথে!
শহরের অন্ধকার সর্বদা নিগূঢ়। জোনাকি বা ঝিঁঝিঁপোকার ডাক কোনটার অস্তিত্ব নেই। আছে কলকারখানার অস্থির আওয়াজ। আছে রাস্তার পাশে জমেথাকা জল, মনের ভিতরের জমে থাকা ভালোবাসা, প্রত্যাখ্যানের ভয়, আর ঠোঁটের পাশের জন্মগত জরুল। আজ কী বলতে পারবে পার্থকে ওর ভালোবাসার কথা! নাকি পার্থ প্রতিভার সাথে সুখে আছে! কিংবা অন্যকারও সাথে!
বাড়ির ভিতরে ঢুকে অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে যায় পৃথা। টেবিলের একপ্রান্তে অসংখ্য টিকটিকি জড়ো করা।
সেগুলো লেজ কেটে পার্থ মুখে নিয়ে চিবোচ্ছে, একএকটা টিকটিকি ছটফট করতে করতে মরে যাচ্ছে। গোটা ঘরময় পচা গন্ধ। কিচ্ছু বুঝতে না পেরে বিনা বাক্যব্যয় করে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই পৃথা। অনিশ্চয়তার বেড়াজাল টপকে হঠাৎ-ই দেখা হয় পার্থর বাবা মার সাথে। জানা গেল গতবছর প্রতিভা চাকরির কারণে ব্যাঙ্গালোর যায়। দেখানে অফিসের বস এর সাথে বিয়েও হয়ে যায়। প্রাথমিকভাবে নিজেকে সামলাতে পারলেও দিনে দিনে ভেঙে পরে পার্থ। বেশ কয়েকবার মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয়েছেন তারা। এসময়ে পার্থর পাশে কেউ একজন থাকা অত্যন্ত জরুরি। পৃথা কিছুক্ষণের জন্য স্তম্ভিত হয়ে যায়। কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় ভাবতে থাকে কী করা উচিত..... অথচ মন থেকে কোনও উত্তর আসেনা।
ঘড়িতে ঘন্টা বাজলো, রাত বারোটা। তিনটে কাটা এক জাগায় দাঁড়িয়ে। চারিদিকে নির্জন নিস্তব্ধ অন্ধকার।
© Sudip Sen
14/Oct/15
0 Comments
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন