মহালয়ার পর পুজোর আমেজটা বাচ্চাদের কালিপটকার আওয়াজ আর বারুদের গন্ধে পাওয়া যায়। কিন্তু, মহালয়ার আগে?

প্রতিবছরেই অমরদাদু একটি নির্দিষ্ট দিনে আমাদের বাড়িতে আসতো। আমাকে বন্ধু বলে ডাকতো। আমার কেমন যেন লজ্জা লাগতো।
এত বড় একটা লোক এইটুকু মানুষের বন্ধু হতে পারে? আমার বন্ধু তো পাড়ার দেবতোষ, প্রীতম, রাজেশ, রাকেশ আর 'জলের অপর নাম'। 'জলের অপর নাম' আবার কারো নাম হয়? একটু বুঝিয়ে বলি, কৃষ্ণর বাবার বাজারে সেলুন। নাম জীবন। প্রথমে কৃষ্ণকে আমরা 'নাপিত ' বলে ডাকতাম। বেচারা খুব রেগে যেত। একদিন অভিমান করে বললো 'আর যাই বলিস! নাপিত বলিস না'।
সুমনের মাথায় তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, বললো...
- তাহলে তোকে জীবন বলে ডাকব। পাশ থেকে রাকেশ বলে উঠেছিল, বিজ্ঞান বইএ পড়িস নি!!
'জলের অপর নাম জীবন'!
ওকে আমরা 'জলের অপর নাম' বলেই ডাকব।
কৃষ্ণ আর কোনও প্রতিবাদ করেনি।

অমরদাদু প্রথমে একটা নারকেল দড়ি পিঠের সাথে বাঁধতো, লুঙির পিছনে একটা দা আটকানো থাকতো , তারপর দুপায়ের সাথে গোলকরে একটা দড়ি বেঁধে গাছে উঠে যেত। কচি নারকেল খেতে মন্দ লাগতো না। কিন্তু যখন মায়ের সাথে নারকেলের 'বাগরা' (সঠিক শব্দটা জানা নেই) টেনেটুনে এক জাগায় জড়ো করতে হতো.. নারকেল জলের একটা চুয়া ঢেকুর উঠতো। তবু, মনে বেশ আনন্দ হতো, অমরদাদু যখন নারকেল গাছ ঝুড়তে এসেছে......পুজো আসতে আর দেড়ি নেই।

আমরা বড়াবর ইস্টবেঙ্গল। বাবা মা মেড ইন বাংলাদেশ। আমি কিন্তু পিওর ইন্ডিয়ান। আমাদের গ্রামটাতে সব রকম লোকের বাস। ব্রাহ্মণ থেকে শুরু করে নিম্নস্তরের মানুষ। সেই অর্থে জাতিভেদ প্রথা কোনওদিন ই টের পারিনি। আমার মা পুজোর আগে নারকেল নাড়ু, তিলের নাড়ু, চিরে ভেজে নাড়ু বানাত। এছাড়াও খৈএর মুড়কি,
সাদা খৈ গুড়ো করে মিছরি মিশিয়ে মোয়া বানাত।
মুড়ির মোয়া তো সাধারণ ব্যাপার। এই গেল ইস্টবেঙ্গল কালচার।
বাড়ির পাশেই ছিল মোহনবাগান সমর্থক। ওদের ওই ছোলা, মটর, বাদাম, আর কুসুমফুলের বীজ মেশানো হলুদ চালভাজা ! আহ! জিভে জল এসে যাচ্ছে। রোজ সকালে উঠে লিকার চা দিয়ে দেড় ঘন্টা সময় নিয়ে ওই হলুদ মুড়ি চিবোতাম। পুজোর আগে পড়ার হাত থেকে
নিস্তার পেতে এর চেয়ে ভাল আর কোনও উপায় আমার জানা ছিলনা।

আরও আছে, মা প্রতিবার পুজোর আগে একদিন ঘর ঝাড়তো। সেদিন আমিও হাত লাগাতাম, মাকে টুকটাক সাহায্য করতাম। তো ওইদিন যদি কোনও পুরনো খেলনা খুঁজে পেতাম! এখনকার সাড়ে পাঁচ ইঞ্চি স্মার্টফোনে আর তা পাইনা। সেই অর্থে ডাবে আমার কোনও আগ্রহ ছিলনা। কিন্তু মহালয়ার পিকনিকের রাতে, লোকের গাছের নারকেল পেরে দেবতোষ যখন দাঁতে করে নারকেল ছুলে, শানের মেঝেতে ফাটাত...  সেই নারকেল না খেলে কেমন যেন মনে হতো মহান  পুণ্যযোগ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করলাম।

সেদিন কেই বা জানোতো! অমরদাদু মরণশীল। দুবছর হলো আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। দেবতোষ থাকে শিলিগুড়ি, আর 'জলের অপর নাম'? বোম্বে হোটেলের বাটেন্ডার। রাজেশ দুবাই। আর আমি? ভরদুপুরের অন্ধকারে হাতরে ওদের সক্কলকে খোঁজার মিথ্যে চেষ্টা করছি।