ভাই'এর গলা ধরে টিউশন যাওয়ার সকালে নারকেল গাছের নীচে এক শালিক দেখলে আতঙ্ক হতো ছেলেটার, মনে হতো আজ বোধহয় পিসির হাতে মার খেতে হবে।
রবিবারের সকালে শুরু হতো সারাদিনের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা দিয়ে, আজ কৃষ্ণ আর শক্তিমান দেখার দিন, ভিনপাড়ায় যেতে হবে। হাওয়াই চপ্পল বাড়িতে রেখে, 'কোনওরকম পিছুটান থাকলে শক্তিমান-এ মনোযোগ দেওয়া যায় না'।
গত তিনটে সপ্তাহে তিন জোরা হাওয়াই চপ্পল হারিয়েছে। এটা হারালে বাড়িতে নির্ঘাত গৃহযুদ্ধ লাগার সম্ভাবনা আছে।
তখন ইকোনমিক সার্ভে নিয়ে মাথা ব্যাথা ছিলনা। হিসেব রাখতে হ'তনা জিডিপির কত শতাংশ বাজার খাতে ব্যয় হচ্ছে আর কত শতাংশ শিক্ষা খাতে!
সকালে মাংসের ঝোল দিয়ে গরম ভাত সাঁটানোর অপেক্ষাই অধীকতর আনন্দ হতো মা যখন হাতে একটাকা দিয়ে বলতো..
- নে, ইস্কুলে কিছু কিনে খাস।
ওই এক টাকার মধ্যেই আমি দেখতে পারতাম স্কুলগেটে বসা আলুকাবলি। নীল-সবুজ আলুকাবলি আমি খেতাম না, বরং তেতুলগোলা জল আমায় খেত।
বীজগণিত আমার মাথার ঢুকতো না। আরে এ, বি, সি, স্কোয়ার, হোলস্কোয়ার, কিউব এসব দিয়ে আবার অঙ্ক করা যায় নাকি? মনে হতো আমি ক্লাস ওয়ানে পড়ি, স্যার এ,বি,সি,ডি শেখাচ্ছে।
তখন ভারতীয় সংবিধানের তিনশো সত্তর নম্বর অনুচ্ছেদ জানা ছিল না। কিন্তু টিউশনের স্যার যখন কামিনীর গায়ে হেলে পড়ত, মনে হতো এই মেয়েটি স্যারের সংবিধানের এক বিশেষ মর্যাদা ভোগ করে।
তখন ভ্যালেন্টাইন'স ডে জানতাম না। প্যালেস্টাইন ডে'তে কেউ একশ তেতাল্লিশ(143) বললে মনে হতো সংবিধানের আইন সংক্রান্ত প্রশ্নে বাড়ির সুপ্রিম কোর্টের কাছে পরামর্শ নেওয়ার সময় এসেছে।
তখন ভূগোলের পরিধি ছিল সীমিত, পাহাড় -মালভূমি -সমভূমি তেই আবদ্ধ । এখন মনে প্রায়শই ভূমিকম্প হয়, অগ্নুৎপাতের লাভা বেড়িয়ে আসে।
বিজ্ঞানে পরিবেশ কাকে বলে জানলেই হয়ে যেত।
পরীক্ষাতে প্রশ্ন আসতো.. 'কেমন জল পান করা উচিৎ?' উত্তর ছিল 'বিশুদ্ধ '।
এখন প্রতিসেকেন্ডে পরিবেশের দূষণ চোখে পড়ে, ফিল্টার ছাড়া বিশুদ্ধ জল পাওয়া কঠিন।
সহজ কয়েকটা ইংরেজি শব্দ শিখলে মনে হতো পুরো Etymology আমার আয়ত্তাধীন, এখন মনে হয়, না ভাল বাংলা জানি, না ভাল ইংরেজি!
তখন মঙ্গলবার এলেই বন্ধুবান্ধব মিলে পাড়ার জঙ্গল ছাপ করতে চলে যেতাম, রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন, কিভাবে অমান্য করি?
এখন রবীন্দ্রনাথের কথা আর শুনিনা, নিতান্তপক্ষে গভর্নমেন্ট ইনিশিয়েটিভ, চাকরির পরীক্ষাতে আসার সম্ভাবনা আছে, তাই কুরুক্ষেত্র জার্নাল থেকে আর্টিকেলটা পড়ে নিই।
তখন ইমেইল ছিলনা, রবিবারে আকাশবাণীতে শিশুমহল আর ছুটিরঘণ্টা শুনতাম। শুচিস্মিতা পিসিমণিকে চিঠিও লিখতাম। এখন বড় হয়ে গেছি, রেডিওটা সমাধির তলে।
এখন ব্রান্ডেড জিন্স, টিশার্ট, জুতো ব্যবহার করি, কিন্তু বাবার দেওয়া গাডার লাগানো প্যান্ট আবার যদি ফিরে পেতাম, এবছর পুজোতে বন্ধুর কাঁধে কাঁধ রেখে বন্দুকে ক্যাপ ভর্তি করে আবার বাচ্চা হয়ে যেতাম।
আজ তো রবিবার, তোরা যাবি নাকি? আমার সাথে হাওয়াই চপ্পল খুলে রেখে, গাডার দেওয়া প্যান্ট পরে ভিনগাঁয়ের সাদাকালো টিভিতে শক্তিমান দেখতে?