পারস্পরিক

শ্মশানঘাটে একটা শকুন বসে। শকুনের পাশে তুলসীমঞ্চ। তুলসীবেদিতে শিউলি গাছের ছায়া পড়েছে। শিউলি গাছটা থেকে একটা ঘট ঝুলছে, সেখান থেকে টুপ টুপ করে জল পড়ছে। তুলসীর জীবন সতেজ রাখছে।

তুলসীর পাশে পোড়ো বটগাছখানা। কবে থেকে সালোকসংশ্লেষ করতে করতে বেড়ে উঠেছে, বুড়ো হয়েছে। পোড়ো হয়েছে। এত দিন ধরে ছায়া দিয়েছে, আশ্রয় দিয়েছে। এখনও দেয়। মানুষ তার কথা মনে রাখে না আলাদা করে, অথচ তারা গ্যালন গ্যালন অক্সিজেন চায়। বটগাছের মনে স্বার্থপর মানুষের কথা ভেসে ওঠে। শৈশবে তাকে অনেক সংগ্রাম করে বেড়ে উঠতে হয়েছে। কখনও কেউ পাতা ছিঁড়েছ, ডাল ভেঙেছে গরু তাড়ানোর জন্য। কেউ আবার দেহের নরম অংশে ঠুকরে ঠুকরে খোদাই করেছে নিজের ব্যর্থ প্রেম।

বটগাছ আজ ক্লান্ত, কিন্তু নিঃসঙ্গ নয়। তার ছায়ায় বসে রয়েছেন ভেঙে পড়া এক বৃদ্ধ। আরও শ্রান্ত, আরও করুণ। বুকের জিরজিরে হাড়গুলোর নীচে পেট দেখা যায় না, কোন গর্তে মিলিয়েছে সে। কোঠরে দু'জোড়া চোখ আছে, অনেকটা ভেতর থেকেও জ্বলজ্বলে। গাল দু'টো শুকিয়ে পরস্পরের সঙ্গে মিশে গিয়েছে প্রায়। মুখে বিবর্ণ দাড়ি। হাত পা অত্যন্ত ক্ষুদ্রাকৃতি, যেন গুটিয়ে ছোট হয়ে গিয়েছে। কোমরটা ভেঙে পড়েছে। কপালে বড় একটা ফোঁড়া উঠেছে। রক্ত ঝরছে। মাছি তাদের শোষক নল দিয়ে মহানন্দে খাদ্যগ্রহণ করছে সেখান থেকে। বৃদ্ধ তাড়াতে চাইছেন না। শেষ বয়সে কেউ যদি তাঁর দেহরস পান করে ক্ষুন্নিবৃত্তি, তাতে কোনও ক্ষতি নাই।

আজ তিন দিন হল কেউ মরেনি। শ্মশানে কারও দেখা নেই। কেউ মারা গেলে তবেই বৃদ্ধের খাবার মেলে। মড়া আনার সময়ে ছিটানো বাঁচানো খইগুলো বৃদ্ধ কলাই করা বাটিতে করে কুড়োয়। তাই দিয়েই তাঁর আহার সম্পন্ন হয়। মরা পোড়াবার সময়ে নিয়মকানুন বলে দিলে কেউ কেউ বৃদ্ধের হাতে খুচরো টাকাও গুঁজে দেয়। কেউ কেউ আবার পর জন্মে পুণ্যের আশায় মৃত ব্যক্তির সঙ্গে চাল, আলু আর তার নিত্য ব্যবহারের কিছু সামগ্রী ফেলে রেখে যায়। তাই দিয়েই বৃদ্ধের পেট চলে, জীবন চলে। এ চলা কেমন চলা!

কিন্তু এই তিন দিনে কেউ আসেনি সৎকার করতে। নাকে আসেনি সস্তা ধুপের গন্ধ। পাওয়া যায়নি মড়া পোড়ার পরিচিত কটূ-গন্ধ। কানে শোনেনি...'বলো হরি, হরিবোল.....বলো হরি.....।'

শকুন বৃদ্ধের দিকে চেয়ে রয়েছে। ভাবছে, কখন বৃদ্ধ শেষ নিঃশ্বাস ছাড়বেন। তার পর তাকে দিয়ে শকুনের মহাভোজ। শকুন বৃদ্ধের মৃত্যুকাঙ্ক্ষী। গাছ থেকে দুটো শিউলি ফুল পড়ল বৃদ্ধের পায়ের কাছে। ফ্যাকাশে, হলদেটে, বিবর্ণ।

বৃদ্ধ শকুনের দিকে চেয়ে রয়েছেন। ভাবছেন, শকুন যদি মুরগি হতো তা হলে নিভু চিতার আঁচে পুড়িয়ে ওটাকে খাওয়া যেত। মিটত খিদের জ্বালা।

শকুনও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বৃদ্ধের পানে চেয়ে। ওর চোখ থেকে অভিশাপ ছুটছে। যেন বলছে.....বুড়ো মর,তোকে খেয়ে আমি ক্ষুধার্ত আত্মাকে শান্তি দেব।

শকুনের পিঠে তিনটে সাদা শিউলি ঝরে পড়ল। এই মুহূর্তে কেন কে জানে শকুনটাকে শত্রু নয়, ঈশ্বরদত্ত দূত মনে হল বৃদ্ধের।

বৃদ্ধের কপালের ফোঁড়া থেকে মাছি উড়ে গেল। ঘট থেকে জল পড়াও থেমে গেল এক সময়। বটগাছের ডাল থেকে একটা কাক কা কা করে উড়ে আকাশে মিলিয়ে গেল। বৃদ্ধ তার ভাঙা কুটিরে প্রবেশ করলেন। মাটির পাত্রে জল নেই। চাল নিঃশেষ এক দিন আগেই। মাথায় এখন শুধু একটাই চিন্তা.....শকুন যদি মুরগি হত, ঝলসে খাওয়া যেত। কিংবা ওর রক্ত দিয়ে তৃষ্ণা মেটানো যেত। ফের ঘর থেকে বেরিয়ে বটগাছের তলায় শরীরটাকে টেনে এনে ময়লা ধুতিটার খুঁট বিছিয়ে শুয়ে রইলেন বৃদ্ধ।

তুলসীবেদীর দিকে চেয়ে অজানা সব চিন্তারা ভিড় করে মাথায়। ভাবতে থাকেন, জীবনের চরম লক্ষ্য হল মোক্ষ। অর্থাৎ নির্বাণ লাভ। ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্মবোধ এবং ইহজগতের সমস্ত পার্থিব বস্তু সম্পর্কে অনাসক্তি বোধই মুক্তিলাভের একমাত্র পথ। আর এই মুক্তিলাভের জন্য আত্মার বিশুদ্ধতা ও জ্ঞানের প্রয়োজন। নিখুঁত মানসিক শান্তিলাভের জন্য পার্থিব বাসনা থেকে বিচ্ছিন্নতাই মানুষকে সংসার এবং পুনর্জন্মের বন্ধন থেকে মুক্ত করে। ভাবতে থাকেন বৃদ্ধ....জীবন আর মৃত্যুর মাঝে লাভ ক্ষতির সূক্ষ্ণ হিসেব কষতে থাকে দু্র্বল মস্তিষ্ক।

শকুন বৃদ্ধের মৃত্যুর অপেক্ষায় সময় গুনছে। তাঁর মৃত্যুর পর শকুন নিজের উপবাস ভাঙবে। শকুনকে দেখে বৃদ্ধের মায়া হয় এ বার। আত্মার অবিনশ্বরতায় বিশ্বাস করেন, তাই মৃত্যুকে নেহাতই তুচ্ছ মনে হয়। পরম ইচ্ছা হয় নিজেকে দিয়ে অন্যের পূরণ ঘটানোর। ঈশ্বরকে স্মরণ করেন। শেষ পুণ্যযোগে তাঁর অন্তিম উদ্ধারের প্রার্থনা করেন।

চোখ বুজে আসছে। আর তখনই সমস্ত ইন্দ্রিয়ে প্রবাহিত হল একটা পরিচিত শব্দ-গন্ধ। ....'বলো হরি..হরিবোল'.. সঙ্গে সস্তা ধূপের গন্ধ। আরও এক বার ক্লান্ত চোখ খুলে শব্দ-গন্ধকে চেখে দেখার চেষ্টা করেন বৃদ্ধ। শব্দটা যত কাছে আসছে, ততই যেন মনে হচ্ছে তাঁর জীবন বয়ে আনছে কোনও এক অচেনা মরদেহ। শকুন ভাবে, নিশ্চিত শিকার কি তবে ফস্কে গেল! অনেক কাছে এখন ওরা। আবার বাঁচতে ইচ্ছে করছে বৃদ্ধের। নাকে তীব্র ভাবে প্রবেশ করে এক ঝলক ধূপের গন্ধ। কিন্তু এ তো জীবন নয়, সাক্ষাৎ মৃত্যুর গন্ধ।

হঠাৎ বটগাছের একটা ডাল ভেঙে পড়ল বৃদ্ধের মাথায়।