পাপ
ঠিক শহর বলা যায় না, আবার মফস্বলও নয়। উঠতি শহর বললে হয়তো ঠিক বোঝানো হয়। আর এটাই সে শহরের প্রাচীনতম দুর্গা মন্দির। মূর্তিটা বহু পুরনো, জীর্ণ। এ দুর্গার দশটা হাত নেই। রঙচঙও উঠে গিয়েছে, চোখমুখ ভাল বোঝা যায় না। সত্যি বলতে কি, মূর্তির ঠিক তলায় শিবলিঙ্গটা রাখা না থাকলে যে কোনও দেবীর মন্দির বলেই চালানো যেত। শিবলিঙ্গের মাথাটা দেবীর দিকে উঁচু হয়ে আছে। মরা আকন্দ ফুলের পাপড়িতে শিবলিঙ্গের চোখ ঢাকা।
শীত পেরোনো শেষ বেলায় আধো অন্ধকার নেমে এসেছে। অসময়ে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। সঙ্গে বাজের শব্দ। আর মাঝে মাঝেই অন্ধকার ফুঁড়ে বিদ্যুতের ঝলকানি।
অরুণ মন্দিরের গেটে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্লাস এইটের এই ছাত্রটার অপাপবিদ্ধ মুখের কচি গোঁফদাড়ি নব যৌবন ভোরের প্রথম আলোর খবর বয়ে এনেছে যেন।
অরুণ একটু এগিয়ে দুর্গামূর্তির কোমরে হাত রাখল....বুকে.. চোখের জায়গায় দুটো চেনা চোখ আঁকতে ইচ্ছে করছিল অরুণের। ভ্রমরের মতো দুটো চোখ। শিবলিঙ্গটা ভাল করে দেখছিল অরুণ। দুর্গার নীচে কেমন দৃঢ় ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। দু'পা পিছিয়ে এসে ঠাকুরের দিকে পিছন ঘুরে দাঁড়াল। অচিরেই হাত গেল কোমরের নীচে, প্যান্টের চেনে। কিছু ক্ষণ পরেই মন্দিরের দেওয়ালের এক পাশে ছিটকে বেরোল অরুণের উঠতি যৌবন। বসন্তের অকাল বর্ষনে মৃত্যু হল এক নিষ্পাপ কৈশোরের।
অরুনের ডান হাত প্রথম পাপের আদ্যক্ষর রচনা করল আজ। ওই সময়ের তৃপ্তিটুকু উপভোগ করতে করতেও অরুণের মনে হল, অবিলম্বে ডান হাত শরীর থেকে কেটে বাদ দেওয়া উচিৎ।
সত্যিই কী অরুন পাপ করেছে? ভাবতে থাকে। বিশ্বাসের বিরুদ্ধে কোনও কিছু করাই তো পাপ। পবিত্র আত্মায় ঈশ্বরের বাস। আর সেই আত্মাকে ব্যবহার করা উচিৎ গৌরবজনক কাজে। এই সত্যকে মনে রেখে আমাদের দেহ ব্যবহার করা উচিৎ। আত্মা যখন গভীর ভাবে আত্মার জৈবিক বাসনার তৃপ্তি চায়, তখনই পাপের উদ্ভব হয়। মনন আর চৈতন্য আধ্যাত্মিক ভাবনার বাধা পেরিয়ে দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে মুক্ত হতে চায়। মনে জাগে নিজেকে ক্ষয় করার বাসনা।
পৃথিবীর সর্বত্র পাপ ছড়িয়ে আছে, হাসপাতালের ডাস্টবিন থেকে শুরু করে মন্দিরের দেওয়াল। মিনিস্টারের পকেট থেকে দুর্গা প্রতিমার মাটিতে।
বৃষ্টির ছাঁটে দেওয়াল ধুয়ে গেল। ধুয়ে গেল দেওয়ালে জড়ানো সদ্য পাপের চিহ্ন। অরুণ শিবলিঙ্গে প্রণাম করল, আর এক বার হাত রাখল দুর্গামূর্তির পেটে...বুকে...ঠোঁটে। মন্দিরের মাটি মাথায় ঠেকিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হল অরুণ। ভিজতে ভিজতেই। নিজেকে ভেজানোর বড় দরকার ছিল।
"নাসতো বিদ্যতে ভাবো না-ভাবো বিদ্যতে সতঃ।
উভয়োরপি দৃষ্টোহন্তস্ত্বনয়োস্তত্ত্বদর্শিভিঃ।"
শ্রীমদ্ভগবদগীতার শ্লোক অরুণের পাপবোধকে দূরে সরিয়ে দেয়। আসক্তিই সুখদুঃখাদি চিত্তচাঞ্চল্যের কারণ। বিষয় কামনা না করেও ভোগ করা যায়, কামনা না করেও কর্ম করা যায়। কামনা ত্যাগ করলেই মানুষ অমর হতে পারে।
পরের দিন ঝকঝকে আকাশ। ভোর ভোর সূর্যপ্রণাম সেরে অরুণ বইয়ের ব্যাগ গোছাতে থাকে। আজও শ্রেয়ার সঙ্গে দেখা হবে স্কুলে। ওর সামনে দাঁড়াতে লজ্জা লাগবে। ওর ভ্রমর-চোখে সরাসরি চায়তে পারবে না। ভিতরের পাপবোধে কাঁকড়ার বাচ্চার মত কুঁকড়ে যায় অরুণ। কুঁকড়েই বেরোয় রাস্তায়। দেখে, শুদ্ধ দেওয়ালে নিষিদ্ধ সিনেমার পোষ্টার। অরুণ মুখ ফিরিয়ে নেয়। বাস-রিক্সা-টোটোর ভিড়ে সাইকেল সওয়ারি অরুণ নিজেকে হারিয়ে ফেলে, ভুলে যায় গত কালের বৃষ্টি-বিকেলের কথা।
রাস্তার ধারের দু'টো গোলাপ কিনে বুকপকেটে রাখে। পকেটটা বুকের ওপর, বুকের নীচে হৃদয়। হৃদয়ে শ্রেয়া। আজ পর্যন্ত সাতাশটা প্রেমপত্র জড়ো হয়েছে। প্রত্যেকটার দাঁড়ি কমা আর শেষের জিজ্ঞাসা চিহ্নটা অরুণের মুখস্থ। চিঠির গন্ধে মিশে থাকে শ্রেয়ার হাতের ছোঁয়া, ভালবাসা। ভালবাসা কিন্তু ধর্মগ্রন্থের বাণী মানে না। স্বীকার করে চলে রুঢ় বাস্তববোধ। প্রতিটা মুহূর্তে পরীক্ষার সামনে ফেলে। সেই পরীক্ষায় হার-জিত আছে বলেই আজও পৃথিবীর অস্তিত্ব বর্তমান।
অরুণ সাইকেল চালাতে চালাতেই পকেট থেকে ফুল দু'টো বার করে লম্বা করে শ্বাস নেয়। স্পষ্ট দেখতে পায় ভ্রমরের মতো একজোড়া চোখে কেমন ভালবাসা ঝরবে এই গোলাপ হাতে পেলে।
শেষ বার যখন গোলাপের ঘ্রাণ নিল, অরুণ তখন বড় রাস্তার ধারে। স্কুলের গেটে। স্কুলের অনেকগুলো মুখ এক জায়গায় গোল হয়ে ঘিরে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। আকস্মিক ভাবে কোনও কাকের মৃত্যু ঘটলে কৌতূহলপূর্ণ দৃষ্টি আর প্রবল স্বরধ্বনি নিয়ে এ ভাবেই জড়ো হয় সব কাক।
একটা সাইকেল দুমড়ে পড়ে আছে ভিড়ের পাশে। এ রকম একটা গোলাপি লেডিবার্ডেই তো..... অরুণ জ্ঞানশূন্য হয়ে সকলকে সরিয়ে ভিড়ের মধ্যে ঢোকার চেষ্টা করে। জোর করে ভিড় সরিয়ে ভিতরে ঝুঁকে পড়ায় বুক পকেটের গোলাপ দু'টো ছিটকে পড়ে একটা রক্তাক্ত নিথর দেহের উপর। শ্রেয়া!!! অরুন দিশাহারা হয়ে পড়ে। রক্তাক্ত দেহ কোলে তুলে নিয়ে হাসপাতালের দিকে ছুটতে থাকে।
ছুটতে ছুটতে পাপবোধে ক্রমেই ডুবছে অরুণ।
কিন্তু শ্রেয়া! শ্রেয়া কোন পাপের শিকার?
ঠিক শহর বলা যায় না, আবার মফস্বলও নয়। উঠতি শহর বললে হয়তো ঠিক বোঝানো হয়। আর এটাই সে শহরের প্রাচীনতম দুর্গা মন্দির। মূর্তিটা বহু পুরনো, জীর্ণ। এ দুর্গার দশটা হাত নেই। রঙচঙও উঠে গিয়েছে, চোখমুখ ভাল বোঝা যায় না। সত্যি বলতে কি, মূর্তির ঠিক তলায় শিবলিঙ্গটা রাখা না থাকলে যে কোনও দেবীর মন্দির বলেই চালানো যেত। শিবলিঙ্গের মাথাটা দেবীর দিকে উঁচু হয়ে আছে। মরা আকন্দ ফুলের পাপড়িতে শিবলিঙ্গের চোখ ঢাকা।
শীত পেরোনো শেষ বেলায় আধো অন্ধকার নেমে এসেছে। অসময়ে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। সঙ্গে বাজের শব্দ। আর মাঝে মাঝেই অন্ধকার ফুঁড়ে বিদ্যুতের ঝলকানি।
অরুণ মন্দিরের গেটে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্লাস এইটের এই ছাত্রটার অপাপবিদ্ধ মুখের কচি গোঁফদাড়ি নব যৌবন ভোরের প্রথম আলোর খবর বয়ে এনেছে যেন।
অরুণ একটু এগিয়ে দুর্গামূর্তির কোমরে হাত রাখল....বুকে.. চোখের জায়গায় দুটো চেনা চোখ আঁকতে ইচ্ছে করছিল অরুণের। ভ্রমরের মতো দুটো চোখ। শিবলিঙ্গটা ভাল করে দেখছিল অরুণ। দুর্গার নীচে কেমন দৃঢ় ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। দু'পা পিছিয়ে এসে ঠাকুরের দিকে পিছন ঘুরে দাঁড়াল। অচিরেই হাত গেল কোমরের নীচে, প্যান্টের চেনে। কিছু ক্ষণ পরেই মন্দিরের দেওয়ালের এক পাশে ছিটকে বেরোল অরুণের উঠতি যৌবন। বসন্তের অকাল বর্ষনে মৃত্যু হল এক নিষ্পাপ কৈশোরের।
অরুনের ডান হাত প্রথম পাপের আদ্যক্ষর রচনা করল আজ। ওই সময়ের তৃপ্তিটুকু উপভোগ করতে করতেও অরুণের মনে হল, অবিলম্বে ডান হাত শরীর থেকে কেটে বাদ দেওয়া উচিৎ।
সত্যিই কী অরুন পাপ করেছে? ভাবতে থাকে। বিশ্বাসের বিরুদ্ধে কোনও কিছু করাই তো পাপ। পবিত্র আত্মায় ঈশ্বরের বাস। আর সেই আত্মাকে ব্যবহার করা উচিৎ গৌরবজনক কাজে। এই সত্যকে মনে রেখে আমাদের দেহ ব্যবহার করা উচিৎ। আত্মা যখন গভীর ভাবে আত্মার জৈবিক বাসনার তৃপ্তি চায়, তখনই পাপের উদ্ভব হয়। মনন আর চৈতন্য আধ্যাত্মিক ভাবনার বাধা পেরিয়ে দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে মুক্ত হতে চায়। মনে জাগে নিজেকে ক্ষয় করার বাসনা।
পৃথিবীর সর্বত্র পাপ ছড়িয়ে আছে, হাসপাতালের ডাস্টবিন থেকে শুরু করে মন্দিরের দেওয়াল। মিনিস্টারের পকেট থেকে দুর্গা প্রতিমার মাটিতে।
বৃষ্টির ছাঁটে দেওয়াল ধুয়ে গেল। ধুয়ে গেল দেওয়ালে জড়ানো সদ্য পাপের চিহ্ন। অরুণ শিবলিঙ্গে প্রণাম করল, আর এক বার হাত রাখল দুর্গামূর্তির পেটে...বুকে...ঠোঁটে। মন্দিরের মাটি মাথায় ঠেকিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হল অরুণ। ভিজতে ভিজতেই। নিজেকে ভেজানোর বড় দরকার ছিল।
"নাসতো বিদ্যতে ভাবো না-ভাবো বিদ্যতে সতঃ।
উভয়োরপি দৃষ্টোহন্তস্ত্বনয়োস্তত্ত্বদর্শিভিঃ।"
শ্রীমদ্ভগবদগীতার শ্লোক অরুণের পাপবোধকে দূরে সরিয়ে দেয়। আসক্তিই সুখদুঃখাদি চিত্তচাঞ্চল্যের কারণ। বিষয় কামনা না করেও ভোগ করা যায়, কামনা না করেও কর্ম করা যায়। কামনা ত্যাগ করলেই মানুষ অমর হতে পারে।
পরের দিন ঝকঝকে আকাশ। ভোর ভোর সূর্যপ্রণাম সেরে অরুণ বইয়ের ব্যাগ গোছাতে থাকে। আজও শ্রেয়ার সঙ্গে দেখা হবে স্কুলে। ওর সামনে দাঁড়াতে লজ্জা লাগবে। ওর ভ্রমর-চোখে সরাসরি চায়তে পারবে না। ভিতরের পাপবোধে কাঁকড়ার বাচ্চার মত কুঁকড়ে যায় অরুণ। কুঁকড়েই বেরোয় রাস্তায়। দেখে, শুদ্ধ দেওয়ালে নিষিদ্ধ সিনেমার পোষ্টার। অরুণ মুখ ফিরিয়ে নেয়। বাস-রিক্সা-টোটোর ভিড়ে সাইকেল সওয়ারি অরুণ নিজেকে হারিয়ে ফেলে, ভুলে যায় গত কালের বৃষ্টি-বিকেলের কথা।
রাস্তার ধারের দু'টো গোলাপ কিনে বুকপকেটে রাখে। পকেটটা বুকের ওপর, বুকের নীচে হৃদয়। হৃদয়ে শ্রেয়া। আজ পর্যন্ত সাতাশটা প্রেমপত্র জড়ো হয়েছে। প্রত্যেকটার দাঁড়ি কমা আর শেষের জিজ্ঞাসা চিহ্নটা অরুণের মুখস্থ। চিঠির গন্ধে মিশে থাকে শ্রেয়ার হাতের ছোঁয়া, ভালবাসা। ভালবাসা কিন্তু ধর্মগ্রন্থের বাণী মানে না। স্বীকার করে চলে রুঢ় বাস্তববোধ। প্রতিটা মুহূর্তে পরীক্ষার সামনে ফেলে। সেই পরীক্ষায় হার-জিত আছে বলেই আজও পৃথিবীর অস্তিত্ব বর্তমান।
অরুণ সাইকেল চালাতে চালাতেই পকেট থেকে ফুল দু'টো বার করে লম্বা করে শ্বাস নেয়। স্পষ্ট দেখতে পায় ভ্রমরের মতো একজোড়া চোখে কেমন ভালবাসা ঝরবে এই গোলাপ হাতে পেলে।
শেষ বার যখন গোলাপের ঘ্রাণ নিল, অরুণ তখন বড় রাস্তার ধারে। স্কুলের গেটে। স্কুলের অনেকগুলো মুখ এক জায়গায় গোল হয়ে ঘিরে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। আকস্মিক ভাবে কোনও কাকের মৃত্যু ঘটলে কৌতূহলপূর্ণ দৃষ্টি আর প্রবল স্বরধ্বনি নিয়ে এ ভাবেই জড়ো হয় সব কাক।
একটা সাইকেল দুমড়ে পড়ে আছে ভিড়ের পাশে। এ রকম একটা গোলাপি লেডিবার্ডেই তো..... অরুণ জ্ঞানশূন্য হয়ে সকলকে সরিয়ে ভিড়ের মধ্যে ঢোকার চেষ্টা করে। জোর করে ভিড় সরিয়ে ভিতরে ঝুঁকে পড়ায় বুক পকেটের গোলাপ দু'টো ছিটকে পড়ে একটা রক্তাক্ত নিথর দেহের উপর। শ্রেয়া!!! অরুন দিশাহারা হয়ে পড়ে। রক্তাক্ত দেহ কোলে তুলে নিয়ে হাসপাতালের দিকে ছুটতে থাকে।
ছুটতে ছুটতে পাপবোধে ক্রমেই ডুবছে অরুণ।
কিন্তু শ্রেয়া! শ্রেয়া কোন পাপের শিকার?
0 Comments
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন