সকাল থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। রতনের ঘরের খড়ের চালের ফাঁকফোকর দিয়ে বৃষ্টি পড়ছে ঠাকুরের আসনখানার উপর।

একটা থালা, একটা বাটি, কড়াই আর গামলা দিয়েও জল আটকানো যাচ্ছেনা। মাটির দেওয়াল ভিজে গিয়েছে। দেওয়ালের গর্ত দিয়ে সাপ-ব্যাঙ-পোকা-মাকড় ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়ছে।

ভরা বর্ষায় বাবার সব্জির দোকানে বিক্রিতে ভাটা পড়েছে। আর আজ যে হারে ঝমঝমিয়ে একটানা শুরু হয়েছে, তাতে বিক্রি আরও কমবে। তবে আজ রাখি, তাই আশা আছে খানিক ব্যবসার। মেজদি এসেছে গত কাল। সঙ্গে ভাগ্নে। না বুঝেই ও দেওয়ালের মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে খেলার পাটালি বানায়। সাপ-ব্যাঙ ঢোকার পথ বানায়।

রতনের সামনে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা। ভেবেছিল ভাল করে পড়াশুনা করে এ বার পাশ করে গেলেই আর বাবার মত দাড়িপাল্লা ধরতে হবে না। হাটে আলু বেচতে হবে না। বাবার শীর্ণকায় শরীরটা দেখলে রতনের কষ্ট হয়। বাবার হাঁপানি আছে, বেশি খাটলেই শ্বাসের টান ওঠে।

আগে অভাব অনটনের সংসারে দিন রাত চরম ঝগড়া লেগে থাকত মা-বাবার। কিন্তু গত বারের পর থেকে মা এখন আর ঝগড়া করে না। মাস কয়েক আগে এক ভ্যাপসা গরমের সন্ধ্যায় তুমুল ঝগড়া হতে হতে বাবা হঠাৎ করে দাঁতে দাঁত আটকে অজ্ঞান হয়ে যায়। মাথায় জল ঢালার অনেক ক্ষণ পর বাবার জ্ঞান ফেরে।

রতন সে দিন দেখেছিল মায়ের চোখের জল, অসহায় মায়ের হাহাকার। মা সে রাতে বারবার ঠাকুরের সামনে মাথা কুটেছিল আর নিজেকে দোষারোপ করছিল। মায়ের মাথা ফেটে রক্ত বেরোচ্ছিল। মা এখন বাবার মঙ্গল কামনায় হাজারটা ব্রত রাখে। সস্তার ফল-বাতাসায় পুজো দেয় বাড়িতে।

আর রতন ইতিহাস পড়ে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন। জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ড পড়ে ওর গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। মনে হয়, রতন যদি সেই সময় জন্মাত আর শহীদ হতে পারত, জীবনটা ধন্য হয়ে যেত। দেশটা যদি আবার নতুন করে পরাধীন হয়, তবে রতন ঠিক মাস্টারদা সূর্য সেন হবে।

সেই অর্থে অবশ্য রতন এখনও পরাধীন, দারিদ্র্যের ভূত প্রত্যেক বছর দেওয়ালে থাবা বসায় আর একমুঠো মাটি কেড়ে নেয়। হঠাৎ বাবার কথা মনে পড়তেই বই ছেড়ে উঠে পড়ে রতন। বাবার শরীরটা এখনও সারেনি। বাবাকে দেখার জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে স্টেশন পার হয়। রেললাইন ধরেই এগোয় বাজারের দিকে।

একটা ট্রেন ঢুকছে। কুকুরের বাচ্চাটা খাবারের খোঁজে লাইনের আশেপাশে ঘুরছিল। হঠাৎ ট্রেনের চাকায় বোকা কুকুরের পিছন অংশটা কাটা পড়ল। শেষবারের মতো বাঁচার চেষ্টায় আর্তনাদ করে উঠছে। কাটা অংশটা নিয়েই অন্তিম এগোনোর প্রচেষ্টা। এক সময় থেমে গেল ওর কান্না। রতনের চোখে জল এল। ওর জীবনটাও এই অর্ধমৃত কুকুরের বাচ্চাটার মত, যে কোনও সময়ই নিঃশ্বাসটা শেষ বারের মতো ছাড়া হতে পারে।

আর একটু এগিয়ে ঝুমুদিদিদের বাড়ি পড়বে। ওদের বাড়িটা পেরিয়ে পুকুরের পাশ দিয়ে ঘুরলেই বাজার শুরু। ঢুকেই তিন নম্বর দোকানটা বাবার। এক বার ঝুমুদের দাওয়ায় উঁকি মেরে নিল রতন। খাঁ খাঁ রোদে জ্বলা উঠোনে ক’টা মুরগি ঘুরছে।

কপাল ভাল থাকলে বাজারে দেখা হবে। বাবার দোকানের দু’টো ঘর পরেই ঝুমুদিদি বসে। ডিম নিয়ে। কখনও বা ওর মা থাকে। বেশ অনেক দিনের জন্য। পাত্তা মেলে না ঝুমুর। তখন রতন জানে, পাহাড়ে গিয়েছে ঝুমু। এটাই নাকি দিদিটার নেশা। কোন একটা উঁচু শৃঙ্গে চড়ার জন্য এক বার টিভি-কাগজের লোকেরাও ভিড় করেছিল ঝুমুর বাড়িতে, দোকানে। শৃঙ্গের নাম থলয়সাগর। রতন বোঝে না, একটা পাহাড়ের নাম সাগর হয় কী করে। পাহাড়ে যাওয়াও ভাল বোঝে না রতন। শুধু ওই বরফ রাজ্যের দেওয়াল বেয়ে মেয়েটা চড়ে ভাবলেই বুকটা কেমন শুকিয়ে আসে।

ও ভূগোল বইয়ে পড়েছে, পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ সান্দাকফু। কাগজে পড়েছে, ঝুমু নাকি বার সাতেক গিয়েছে ওই শৃঙ্গে। ওটা নাকি কিছুই নয়, নবিসদের হাতেখড়ি দেওয়ার পাহাড় নাকি ওটা। রতন তো অত বোঝে না। তবে ও কিন্তু দিব্য তরতরিয়ে বাড়ির পেছনের নারকেল গাছটায় চড়তে পারে। ছোটবেলায় লোকের বাড়ির পাঁচিল টপকাতেও দড় ছিল রতন। তখন ঝুমুদিদি কথা বলত। ওকে এক বার বলেছিল, "এই ছেলে রক ক্লাইম্বিং করতে পারিস তো...এত ভাল ফিটনেস। রোজ সকালে দৌড়বি আমার সঙ্গে।" তখন দৌড়নো হয়নি, ভোরগুলো কাটত সব্জি গুছিয়ে বাবার ভ্যানে তুলতে, দু'তিন খেপে সব্জি পৌঁছে দিতে। আর এখন ভোরগুলোয় একটু পড়াশোনার চেষ্টা করে। ও ঠিক করেছে, উচ্চ মাধ্যমিকটা শেষ করে এক বার ঝুমুদির সঙ্গে পাহাড়ে চড়া শিখতে যাবে। ভেবেই হেসে ফেলল রতন। ওর টাকা কই? ঝুমুদি বলেছে, পাহাড়ে চড়তে অনেক টাকা লাগে। উঁচু পাহাড়ে চড়ার জন্য ঝুমুদিকে দোরে দোরে ভিক্ষাও করতে হয়। এ ভিক্ষা অবশ্য সব সময় ইংরেজিতে বলতে হয়---স্পনসরশিপ।

মাঝে মাঝে নিজের দিদিদের সঙ্গে ঝুমুদিদির তুলনা করে রতন। তিন দিদিই ছোটবেলায় খুব ডানপিটে ছিল। মেজদিটা স্কুলে ভাল ছিল স্পোর্টসে। স্টেট লেভেলে চান্সও পেয়েছিল, কিন্তু টাকার অভাবে যাওয়া হয়নি। রতন ভাবে, টাকার অভাবে সাত-তাড়তাড়ি বিয়ে কিন্তু আটকায়নি কারও। আর ডানপিটে দিদিগুলোও দিব্যি শান্ত বৌ হয়ে বছর ঘুরতেই একটা করে ভাগ্নে-ভাগ্নি আমদানি করেছে।

বাবার দোকান এসে গিয়েছে। ছাতাটা এক পাশে রেখে বলল, "মাছ কিনে বাড়ি যাও বাবা, আমি বসছি। মা রাঁধবে কখন?" "তুই আবার পড়া ফেলে এলি কেন, আমি দোকান গুটিয়ে যেতাম ক্ষণ"...বলল বাবা।

ঝুমুদি দোকানে নেই। কাকিমা বলল, কলকাতায় কোন মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছে। পরের বার নাকি এভারেস্ট চড়তে যাবে ঝুমুদিদি। এভারস্টের ছবি দেখেছে রতন। পড়েওছে। পড়েছে তেনজিং আর এডমন্ডের কথা। কিন্তু সব পড়ে একটাই জিনিস বোঝেনি, এভারেস্টের নাম কেন মাউন্ট রাধানাথ হয়নি। উনিই তো নাকি প্রথম মেপেছেন পাহাড়টাকে, আর যিনি প্রথম মাপেন তাঁর নামেই তো নাম হয়। কী জানি, ঝুমুদিদিকে জিজ্ঞেস করতে হবে। ভাবতে ভাবতেই পালং শাকগুলোয় জল ছেটাতে লাগল রতন। আর কাকিমার কথাগুলো ভাবতে লাগল। পরের মার্চে যাবে ঝুমুদি। মানে রতনের তখন উচ্চমাধ্যমিকের চাপ। এখানে এক একটা পরীক্ষা নিয়ে হিমশিম খাবে রতন, আর সেই কোন বরফ খাঁজে আরও কঠিন পরীক্ষা দেবে ঝুমুদি। রতন জানে, তার পরীক্ষায় পাশ-ফেল আছে, আর ঝুমুদির পরীক্ষায় শুধু জীবন-মৃত্যু।

দুপুর পার করে দোকান গুটিয়ে ফিরছিল রতন। স্টেশনের ধারে পুটু-গোলা-ন্যালাদের আড্ডাটা চোখে পড়ল। পাড়ার খারাপ ছেলে বলেই পুটুদের চেনে সবাই। ছিঁচকে চুরি, নেশা করাই শুধু নয়, গ্যাঙের প্রত্যেকটা ছোকরার একটা-দু'টো করে পুলিশ কেস আছে। ওদের টুকরো কথা কানে এল। "দেখিস না কেমন ছেলে ছেলে ভাব, এ দিক ও দিক একা ঘোরে...সস্তা মাল শালা"..."পাহাড়ে গিয়ে দশ জনের সঙ্গে শুতে পারে, আমাদের সঙ্গে একটু শুতে পারবে না খানকি মাগি?" ....হাড় হিম হয়ে গেল রতনের। ওরা ঝুমুদির কথা বলছে! ঝুমুদি!

সে দিন নাকমুখ ফাটিয়ে, ল্যাংড়াতে ল্যাংড়াতে ঘরে ফিরল রতন। মাথা ঝনঝন করছে। একা পারেনি চার-পাঁচটা ষণ্ডার সঙ্গে। শেষের দিকে কুলি কলোনির দুটো দাদা ছুটে না এলে আজ হয়তো মরেই যেত রতন। মেজদি অবাক হয়ে বলল, "ঝুমুকে নিয়ে দু'টো কথা বলল বলে তুই এমনি মার খেয়ে এলি!" রতন কী করে বোঝাবে, যে দিদিদের সন্তান কোলে নিয়ে স্বামীর জন্য ভাত রাঁধতে দেখতে দেখতে নিজের যে ছটফটে ও দিদিদের হারিয়ে ফেলেছে, সেই দিদিদের ও ঝুমুদির মধ্যে খুঁজে পায়। ও কী করে বোঝাবে, ঝুমুদি শুধু ওদের এলাকার নয়, সারা বাংলার গর্ব।

কপালের ব্যান্ডেডটায় হাত বোলাতে বোলাতে ভোরবেলার ইতিহাসের অধ্যায়গুলো মনে পড়ছিল রতনের। না শহীদ হতে পারেনি, কিন্তু একটা মেয়েকে চরম সর্বনাশের শিকার হওয়া থেকে বাঁচাতে পারল হয়তো। ঝুমুদি হয়তো জানবে না, কিন্তু ওর আরও অনেক অনেক পাহাড় জয়ের পিছনে আজকের এই রাখির দিনটা লুকিয়ে থাকবে। লুকিয়ে থাকবে রতনের অনেকটা রক্ত-কান্না-কষ্ট। লুকিয়ে থাকবে বিড়ালের নরম থাবার মতো একটাঅসম্পর্কীয় ভ্রাতৃত্ব। রতন লুকিয়েই রাখবে। সব কিছু বাজারি করা যায় না যে...