আত্মরতিতে কোনও পাপবোধ খুঁজে পায়না চৈতী। বরং অন্তর্দাহে জ্বলার থেকে, অন্যের কোনও অসুবিধা না করে নিজেকে খুশি করার মধ্যে এক রকম আত্মবিশ্বাসই অনুভব করে।
বিয়ের পর বারো বছর পার হয়েছে। এখন বেশির ভাগ সময় বাড়িতেই একলা কাটে। অপূর্ব মেক্যানিকাল ইঞ্জিনিয়ার। বৌকে দেওয়ার মতো খুব বেশি সময় বা ইচ্ছে তার নেই। তাই আটত্রিশ বছরের এই 'বালিকা'র বিষণ্ণ দুপুর এখনও কাটে পুতুল খেলে। এই পুতুল খেলাই কখনও আবার জ্যান্ত মানুষ নিয়ে খেলা হয়ে ওঠে।
কবে থেকে নেশা শুরু হয়েছে মনে করতে পারে না চৈতী। নেট সার্ফ করতে করতে প্রায়ই চোখে পড়ত বিজ্ঞাপনগুলো.. একলা গৃহবধূদের সময় কাটানোর এবং রোজগারের পথ বাতলানোর লাস্যময়ী ছবিগুলো। এক দিন সাহস করে পা বাড়িয়ে ফেলেছিল.. শরীরের খিদে ছাড়াও ছিল নিষিদ্ধ একটা আকর্ষণ। তার পর থেকেই শুরু অজানা, উষ্ণ সম্পর্কের আঁচ.. সবটাই স্কাইপে, একলা দুপুরে।
স্কাইপ প্রোফাইলে নিজের একটা নাম দিয়েছে চৈতী। তৃষিতা। নিজের নামটা ছোটবেলায় একদম পছন্দ ছিল না চৈতীর। বাবা বুঝিয়েছিলেন, সব মাসের শেষে আসে চৈত্র মাস। বসন্তের ডালি সেজে ওঠে সে মাসে। তুমিও তেমনই বাসন্তী হয়ে উঠবে সবার শেষে হলেও... আজ অবধি বাবার কথার সত্যতা খুঁজে পায় না চৈতী। যৌবনের শেষ যতই কাছে আসছে, শরীর ততই বসন্ত হারাচ্ছে।
সকাল সকাল অপূর্ব বেরিয়ে যায়। তার পর একটু বেলা হলেই রোজ সাজতে বসে চৈতী। সুতীক্ষ্ণ নখে রঙের পরত, ঠোঁটে লিপস্টিক, চোখে কাজল। চুল পরিপাটি করে বাঁধে, মুখে দামী ক্রিম মেখে রেখাগুলো ঢাকে। তার পর পারফিউম লাগায়। বড় আয়নাতে চোখ যায়। নিজেকে দেখে। বুকদুটো আর আগের মতো নেই, একটু যেন শিথিল। ঠোঁটে নেই অষ্টাদশীর প্রাকৃতিক বর্ণ। স্নানের শেষে শারীরিক সুমিষ্ট ঘ্রাণ এখন আর পাওয়া যায় না। চোখের কোলে জমেছে কালো ছোপ। তবুও কার জন্য এই কৃত্রিম রূপের ডালি? কে তাকাবে তার কালো চোখে? রঙিন ঠোঁটেই বা কে আশ্রয় নেবে? শেপ করা নখগুলো কার পিঠেই বা দাগ ফেলবে? স্কাইপের কোন অপরিচিত 'বন্ধু'ই কি রোজ 'ভোগ' করবে চৈতীকে?
কোনও দিন বা সাজগোজ সারা হলেই পলকে পাল্টে যায় চৈতীর মন। কাজল মুছে ফেলে, মুছে ফেলে ঠোঁটের রঙ। চোখের জলে ধুয়ে যায় মুখের ক্রিম। নিজেকে অনাবৃত করে..সব কেমন যেন ফুরিয়ে গেছে!
বিয়ের পরেই কুলটি ছেড়ে নিউটাউনের ফ্ল্যাটে চলে আসে অপূর্ব-চৈতী। স্বাচ্ছন্দ্য ঘরের প্রতিটা কোণায়। আগে ভালবাসাও মিশে ছিল সব কিছুর সঙ্গে। কিন্তু আস্তে আস্তে সব কেমন ফাঁকা হতে শুরু করল...সব কেমন যেন ফুরিয়ে গেল!
এই শহরটার মতোই। বারো বছরে শহরটার অনেক পরিবর্তন দেখেছে চৈতী। আগে নিউটাউনের মধ্যে একটা গ্রাম-গ্রাম ব্যাপার ছিল। এখন ফ্ল্যাটবাড়ির সমীকরণে শহরটাও কেমন যেন অপূর্বর মত শুকনো খড়খড়ে হয়ে পড়েছে। আবেগ নেই, শুধু বেগ আছে। আছে দূষণ। গাড়ির তীব্র হর্ন। রাস্তার রবীন্দ্রসংগীতও আছে, কিন্তু তাতে নেই শান্তিনিকেতনী সুর।
অপূর্ব... যার জন্য এক সময় পাগল ছিল চৈতী। মন খাঁচার পাখির মত ছটফট করত, একটু দেখার আশায়। কথা থেমে যেত। হঠাৎ দেখায় শরীর-মন শিউরে উঠতো।
বিয়ের পর প্রথম প্রথম অপূর্ব চৈতীকে চিঠি লিখত। অফিস যাওয়ার আগে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরত। জোর করে ঠোঁট ঠোঁট রাখত। চৈতী টাই বাঁধতে বাঁধতে অপূর্বর বুকে নিজেকে মিশিয়ে দিত।
আর এখন.....অপূর্ব মুখ ফিরিয়েও চায় না চৈতীর দিকে। হয়তো অপরাধবোধ অপূর্বকে দুরে ঠেলে দিচ্ছে। যে দিন অপূর্বর 'ইরেকটাইল ডিসফাংশন' ধরা পড়ল, সে দিন ওদের পঞ্চম বিবাহবার্ষিকী। রিপোর্ট হাতে পেয়ে অপূর্ব বুঝতে পেরেছিল ও 'ইমপোটেন্ট'। ছিঁড়ে ফেলেছিল বিছানায় সাজানো রজনীগন্ধা। একটা আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল চৈতীর ওপর। এ রকম বীভৎস আদরের স্বাদ চৈতী আগে কখনও পায়নি। অপূর্ব বারবার বলছিল, "আমি পারি না? পারি না আমি তোমায় খুশি করতে?" নিষ্ফল রাগে নিজেকে নিঃশেষ করার পর থেকেই কেমন হয়ে গিয়েছিল অপূর্ব।
কোন উৎফুল্লতা নেই। শুকনো মাটির কলসির মত খটখট বাজে। সকাল ন'টায় বাড়ি থেকে বেরোয়, আর রাত বারোটায় বাড়ি ফেরে। সব সময় যে অফিসের কাজ থাকে তা-ও নয়। অফিস থেকে কখনও কলিগের বাড়ি সায়শন করতে যায় অথবা অন্য কাউকে নিয়ে অন্য কোথাও। বাড়ি ফিরে এতটাই ক্লান্ত থাকে যে, জামাটুকুও বদলায় না। আলো নিভিয়ে দেওয়ালমুখো হয়ে শুয়ে পড়ে, পা দুটো কোলবালিশ জড়িয়ে থাকে।
প্রথম প্রথম চৈতী চেষ্টা করত। পিঠে আদর করত, মাথায় বিলি কাটত, জোর করে ঠোঁট ছুঁত.....কিন্তু সাড়া না পেয়ে বড় অপমানিত লাগত নিজেকে। মেয়েরা আর সব সহ্য করতে পারে, শরীরি প্রত্যাখান নয়। চৈতীর মনে হতো, সমস্যাটা যেন ওরই। ওরই যেন সব অপরাধ।
চৈতী অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছিল, যৌন সম্পর্কের ঢেউয়ে ভালবাসার তীরে যেন আঁচড় না পড়ে। রিপোর্ট পাওয়ার আগেও অপূর্ব নিজের অক্ষমতার কথা বুঝতে পারত। তবে তাতে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরা বা আকস্মিক চুম্বনে কোনও প্রভাব পড়েনি। দুর্বলতার কথা প্রকট হতেই অপূর্ব নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল। যেন জীবনের সব সুখ ভুলে এক যন্ত্রণার সাগরে দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য নাবিক হয়ে গিয়েছে। এ ভাবেই সাতটা বছর পেরিয়েছে, পেরোচ্ছে।
এই পর্বটা চলাকালীনই হঠাৎ ফেসবুকে কৌশিককে খুঁজে পায় চৈতী। কলেজের ক্লাসমেট। এখন অনলাইন বিজনেস করছে। ছেলেটা এই বয়সে এত উন্নতি করেছে, ভাবা যায় না। এক সময় ওকে বেশ মনে ধরত। কলেজের সেমিনার থেকে শুরু করে সরস্বতী পুজো, শিক্ষকদিবস থেকে এক্সকারশন--- সব কিছুতেই কৌশিক সবার আগে। ভাল কবিতা লিখত, ক্যুইজ কম্পিটিশন, মক পার্লামেন্ট, চেস, টেবিল টেনিস আর সেমিস্টারের রেজাল্ট। সব কিছুতেই ওর জুড়ি মেলা ভার। কলেজের অনেক মেয়েই ওর জন্য পাগল ছিল। চৈতী বুঝতে পারত, অন্য মেয়েদের থেকে কৌশিক ওকে একটু বেশিই গুরুত্ব দিত। কিন্তু সে ভাবে কোনও সম্পর্ক তৈরি হয়নি ওদের। কিন্তু জীবনের এই দ্বিতীয় দফায় পৌঁছে, ভার্চুয়্যাল জগতের লাইক-কমেন্ট-ইনবক্স-হোয়াটসঅ্যাপ-ফোন কল থেকে কেমন যেন একটা বসন্তের মরসুমী ফুলের বাগানের মতো হয়ে উঠল ওদের সম্পর্কটা।
এখন কিছু দিনের জন্য কৌশিক ব্যাঙ্গালোর থেকে কলকাতায় এসেছে। আজ বিকেলে বেরোলে মন্দ হয়না। কিছু শপিং সারবে, খাওয়া-দাওয়া-আড্ডা। সঙ্গে কৌশিক। কৌশিকের হোটেলে গিয়েই দেখা হবে ঠিক হল।
সকাল থেকেই আনচান করছে চৈতী। নিজেকে চিনতে পারছে না। কলেজ জীবনের চপলতায় কাজ সারছে আনমনে।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। কী যেন ভেবে গোলাপি ব্রায়ের হুকটা একটু বেশিই আঁটো করে বাঁধে চৈতি। শাড়ি পরবে ভেবেও, একটা স্কার্ট আর ছোট টপ বেছে নেয়। পরিপাটি করে চুলটা বেঁধেও, ফের খুলে ফেলে আলগোছে ক্ল্যাচার লাগায়। তার পর হাল্কা কাজল ঘষে, ন্যুড লিপস্টিক লাগিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। চমৎকার লাগছে, ঠিক সেই কলেজের দিনগুলোর মতো। আত্মপ্রেমে বিহ্বল হয়ে পরে চৈতী। আবারও মনে প্রশ্ন জাগে, কার জন্য এত সাজগোজ?
ট্যাক্সিতে উঠে আকাশ দেখে চৈতি, মেঘ জমেছে। হয়তো ঝড় জল আসতে পারে! ট্যাক্সি এগোচ্ছে সমস্ত পিছুটান ফেলে। কিসের জন্য এত উৎফুল্লতা বুঝে উঠতে পারে না। হোটেলের সামনে ট্যাক্সি থেমে যায়। যত্নে রাঙানো নখের চাপে নির্দিষ্ট ঘরে কলিং বেল বাজায় চৈতী। কৌশিক দরজা খুলে হাসি মুখে সম্বোধন করেই ওকে জড়িয়ে ধরে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায়। ঘরের ভিতরে নিয়ে যায়। টাকার সঙ্গে মানুষের চেহারা আর বেশভূষার যে পরিবর্তন ঘটে, তা প্রকট ভাবে ধরা পড়ছে কৌশিকের মধ্যে। কৌশিক গ্লাসে ওয়াইন ঢালছে বোতল থেকে। কৌশিকের সঙ্গে এতটা সচ্ছন্দ হওয়াটা কি ঠিক হবে?
ঘরে গান বাজছে,
"পিপাসা হায় নাহি মিটিল, নাহি মিটিল।।
গরলরসপানে জরজরপরানে
মিনতি করি হে করজোড়ে,
জুড়াও সংসারদাহ তব প্রেমের অমৃতে।।"
কথা বলছিল ওরা। অনেক কথা। পুরনো কথা, নতুন কথা, না বলা কথা, বলা কথা.....সব। আস্তে আস্তে একটা উত্তেজনা অনুভব করছিল চৈতী। গ্লাসের অর্ধেক পানীয় শেষ করার পর স্পষ্ট বুঝতে পারছিল, গোলাপি ব্রায়ের নীচে জেগে উঠছে স্তনবৃন্তেরা। এ কী নতুন অভ্যেসের ফল? পুরুষমানুষকে শরীর ভাবছে? নারীর সহজাত দৃষ্টি দিয়ে কৌশিকের চোখের ভাষাও নজর এড়ায়নি চৈতীর।
প্রতীক্ষিত কিন্তু অপরিকল্পিত মুহূর্তটা এক সময় এসেই গেল।
কৌশিক চৈতীকে জড়িয়ে ধরল, যে ভাবে অপূর্ব তাকে ধরত। দুহাতে চৈতীকে তুলে নিয়ে কৌশিক এগিয়ে গেল বিছানার দিকে। এ ভাবে অপূর্ব কোনও দিন ওকে আদর করেনি। দীর্ঘদিন পরে ওর চৈতীর শুকনো ঠোঁটে বৃষ্টি নামাল কৌশিকের ঠোঁট..
ঠোঁট ক্রমশ নিম্নগামী। গলা ছাড়িয়ে, গোলাপি ব্রা ছুঁয়ে ফেলেছে। আরও নামছে কৌশিকের ঠোঁট। ওর অবয়ব ক্রমশ উপর নীচ করছে। একি! এ তো অপূর্ব!
চৈতী ভাল করে লক্ষ্য করে কৌশিকের অনাবৃত শরীরটা। কেন পলকে অপূর্ব মনে হল ওকে?
চৈতীর মন কেমন অপূর্ব অপূর্ব করছিল। অপূর্ব ভাল মানুষ অথচ ভাল স্বামী হতে পারল না কোনও দিন।
নিজের অজান্তেই ঝটকানি দিয়ে ফেলে দেয় কৌশিককে। তারপর বেরিয়ে ট্যাক্সি। নিউটাউন চলো।
আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ঘনঘন বিদ্যুতের আলো চোখ ঝলসে দিচ্ছে। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। এ কি বৃষ্টির শব্দ? নাকি নির্বেদ জীবনের আভোগ সঙ্গীতে বাজছে আকুল তিয়াষের শ্রদ্ধাঞ্জলি...
বিয়ের পর বারো বছর পার হয়েছে। এখন বেশির ভাগ সময় বাড়িতেই একলা কাটে। অপূর্ব মেক্যানিকাল ইঞ্জিনিয়ার। বৌকে দেওয়ার মতো খুব বেশি সময় বা ইচ্ছে তার নেই। তাই আটত্রিশ বছরের এই 'বালিকা'র বিষণ্ণ দুপুর এখনও কাটে পুতুল খেলে। এই পুতুল খেলাই কখনও আবার জ্যান্ত মানুষ নিয়ে খেলা হয়ে ওঠে।
কবে থেকে নেশা শুরু হয়েছে মনে করতে পারে না চৈতী। নেট সার্ফ করতে করতে প্রায়ই চোখে পড়ত বিজ্ঞাপনগুলো.. একলা গৃহবধূদের সময় কাটানোর এবং রোজগারের পথ বাতলানোর লাস্যময়ী ছবিগুলো। এক দিন সাহস করে পা বাড়িয়ে ফেলেছিল.. শরীরের খিদে ছাড়াও ছিল নিষিদ্ধ একটা আকর্ষণ। তার পর থেকেই শুরু অজানা, উষ্ণ সম্পর্কের আঁচ.. সবটাই স্কাইপে, একলা দুপুরে।
স্কাইপ প্রোফাইলে নিজের একটা নাম দিয়েছে চৈতী। তৃষিতা। নিজের নামটা ছোটবেলায় একদম পছন্দ ছিল না চৈতীর। বাবা বুঝিয়েছিলেন, সব মাসের শেষে আসে চৈত্র মাস। বসন্তের ডালি সেজে ওঠে সে মাসে। তুমিও তেমনই বাসন্তী হয়ে উঠবে সবার শেষে হলেও... আজ অবধি বাবার কথার সত্যতা খুঁজে পায় না চৈতী। যৌবনের শেষ যতই কাছে আসছে, শরীর ততই বসন্ত হারাচ্ছে।
সকাল সকাল অপূর্ব বেরিয়ে যায়। তার পর একটু বেলা হলেই রোজ সাজতে বসে চৈতী। সুতীক্ষ্ণ নখে রঙের পরত, ঠোঁটে লিপস্টিক, চোখে কাজল। চুল পরিপাটি করে বাঁধে, মুখে দামী ক্রিম মেখে রেখাগুলো ঢাকে। তার পর পারফিউম লাগায়। বড় আয়নাতে চোখ যায়। নিজেকে দেখে। বুকদুটো আর আগের মতো নেই, একটু যেন শিথিল। ঠোঁটে নেই অষ্টাদশীর প্রাকৃতিক বর্ণ। স্নানের শেষে শারীরিক সুমিষ্ট ঘ্রাণ এখন আর পাওয়া যায় না। চোখের কোলে জমেছে কালো ছোপ। তবুও কার জন্য এই কৃত্রিম রূপের ডালি? কে তাকাবে তার কালো চোখে? রঙিন ঠোঁটেই বা কে আশ্রয় নেবে? শেপ করা নখগুলো কার পিঠেই বা দাগ ফেলবে? স্কাইপের কোন অপরিচিত 'বন্ধু'ই কি রোজ 'ভোগ' করবে চৈতীকে?
কোনও দিন বা সাজগোজ সারা হলেই পলকে পাল্টে যায় চৈতীর মন। কাজল মুছে ফেলে, মুছে ফেলে ঠোঁটের রঙ। চোখের জলে ধুয়ে যায় মুখের ক্রিম। নিজেকে অনাবৃত করে..সব কেমন যেন ফুরিয়ে গেছে!
বিয়ের পরেই কুলটি ছেড়ে নিউটাউনের ফ্ল্যাটে চলে আসে অপূর্ব-চৈতী। স্বাচ্ছন্দ্য ঘরের প্রতিটা কোণায়। আগে ভালবাসাও মিশে ছিল সব কিছুর সঙ্গে। কিন্তু আস্তে আস্তে সব কেমন ফাঁকা হতে শুরু করল...সব কেমন যেন ফুরিয়ে গেল!
এই শহরটার মতোই। বারো বছরে শহরটার অনেক পরিবর্তন দেখেছে চৈতী। আগে নিউটাউনের মধ্যে একটা গ্রাম-গ্রাম ব্যাপার ছিল। এখন ফ্ল্যাটবাড়ির সমীকরণে শহরটাও কেমন যেন অপূর্বর মত শুকনো খড়খড়ে হয়ে পড়েছে। আবেগ নেই, শুধু বেগ আছে। আছে দূষণ। গাড়ির তীব্র হর্ন। রাস্তার রবীন্দ্রসংগীতও আছে, কিন্তু তাতে নেই শান্তিনিকেতনী সুর।
অপূর্ব... যার জন্য এক সময় পাগল ছিল চৈতী। মন খাঁচার পাখির মত ছটফট করত, একটু দেখার আশায়। কথা থেমে যেত। হঠাৎ দেখায় শরীর-মন শিউরে উঠতো।
বিয়ের পর প্রথম প্রথম অপূর্ব চৈতীকে চিঠি লিখত। অফিস যাওয়ার আগে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরত। জোর করে ঠোঁট ঠোঁট রাখত। চৈতী টাই বাঁধতে বাঁধতে অপূর্বর বুকে নিজেকে মিশিয়ে দিত।
আর এখন.....অপূর্ব মুখ ফিরিয়েও চায় না চৈতীর দিকে। হয়তো অপরাধবোধ অপূর্বকে দুরে ঠেলে দিচ্ছে। যে দিন অপূর্বর 'ইরেকটাইল ডিসফাংশন' ধরা পড়ল, সে দিন ওদের পঞ্চম বিবাহবার্ষিকী। রিপোর্ট হাতে পেয়ে অপূর্ব বুঝতে পেরেছিল ও 'ইমপোটেন্ট'। ছিঁড়ে ফেলেছিল বিছানায় সাজানো রজনীগন্ধা। একটা আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল চৈতীর ওপর। এ রকম বীভৎস আদরের স্বাদ চৈতী আগে কখনও পায়নি। অপূর্ব বারবার বলছিল, "আমি পারি না? পারি না আমি তোমায় খুশি করতে?" নিষ্ফল রাগে নিজেকে নিঃশেষ করার পর থেকেই কেমন হয়ে গিয়েছিল অপূর্ব।
কোন উৎফুল্লতা নেই। শুকনো মাটির কলসির মত খটখট বাজে। সকাল ন'টায় বাড়ি থেকে বেরোয়, আর রাত বারোটায় বাড়ি ফেরে। সব সময় যে অফিসের কাজ থাকে তা-ও নয়। অফিস থেকে কখনও কলিগের বাড়ি সায়শন করতে যায় অথবা অন্য কাউকে নিয়ে অন্য কোথাও। বাড়ি ফিরে এতটাই ক্লান্ত থাকে যে, জামাটুকুও বদলায় না। আলো নিভিয়ে দেওয়ালমুখো হয়ে শুয়ে পড়ে, পা দুটো কোলবালিশ জড়িয়ে থাকে।
প্রথম প্রথম চৈতী চেষ্টা করত। পিঠে আদর করত, মাথায় বিলি কাটত, জোর করে ঠোঁট ছুঁত.....কিন্তু সাড়া না পেয়ে বড় অপমানিত লাগত নিজেকে। মেয়েরা আর সব সহ্য করতে পারে, শরীরি প্রত্যাখান নয়। চৈতীর মনে হতো, সমস্যাটা যেন ওরই। ওরই যেন সব অপরাধ।
চৈতী অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছিল, যৌন সম্পর্কের ঢেউয়ে ভালবাসার তীরে যেন আঁচড় না পড়ে। রিপোর্ট পাওয়ার আগেও অপূর্ব নিজের অক্ষমতার কথা বুঝতে পারত। তবে তাতে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরা বা আকস্মিক চুম্বনে কোনও প্রভাব পড়েনি। দুর্বলতার কথা প্রকট হতেই অপূর্ব নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল। যেন জীবনের সব সুখ ভুলে এক যন্ত্রণার সাগরে দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য নাবিক হয়ে গিয়েছে। এ ভাবেই সাতটা বছর পেরিয়েছে, পেরোচ্ছে।
এই পর্বটা চলাকালীনই হঠাৎ ফেসবুকে কৌশিককে খুঁজে পায় চৈতী। কলেজের ক্লাসমেট। এখন অনলাইন বিজনেস করছে। ছেলেটা এই বয়সে এত উন্নতি করেছে, ভাবা যায় না। এক সময় ওকে বেশ মনে ধরত। কলেজের সেমিনার থেকে শুরু করে সরস্বতী পুজো, শিক্ষকদিবস থেকে এক্সকারশন--- সব কিছুতেই কৌশিক সবার আগে। ভাল কবিতা লিখত, ক্যুইজ কম্পিটিশন, মক পার্লামেন্ট, চেস, টেবিল টেনিস আর সেমিস্টারের রেজাল্ট। সব কিছুতেই ওর জুড়ি মেলা ভার। কলেজের অনেক মেয়েই ওর জন্য পাগল ছিল। চৈতী বুঝতে পারত, অন্য মেয়েদের থেকে কৌশিক ওকে একটু বেশিই গুরুত্ব দিত। কিন্তু সে ভাবে কোনও সম্পর্ক তৈরি হয়নি ওদের। কিন্তু জীবনের এই দ্বিতীয় দফায় পৌঁছে, ভার্চুয়্যাল জগতের লাইক-কমেন্ট-ইনবক্স-হোয়াটসঅ্যাপ-ফোন কল থেকে কেমন যেন একটা বসন্তের মরসুমী ফুলের বাগানের মতো হয়ে উঠল ওদের সম্পর্কটা।
এখন কিছু দিনের জন্য কৌশিক ব্যাঙ্গালোর থেকে কলকাতায় এসেছে। আজ বিকেলে বেরোলে মন্দ হয়না। কিছু শপিং সারবে, খাওয়া-দাওয়া-আড্ডা। সঙ্গে কৌশিক। কৌশিকের হোটেলে গিয়েই দেখা হবে ঠিক হল।
সকাল থেকেই আনচান করছে চৈতী। নিজেকে চিনতে পারছে না। কলেজ জীবনের চপলতায় কাজ সারছে আনমনে।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। কী যেন ভেবে গোলাপি ব্রায়ের হুকটা একটু বেশিই আঁটো করে বাঁধে চৈতি। শাড়ি পরবে ভেবেও, একটা স্কার্ট আর ছোট টপ বেছে নেয়। পরিপাটি করে চুলটা বেঁধেও, ফের খুলে ফেলে আলগোছে ক্ল্যাচার লাগায়। তার পর হাল্কা কাজল ঘষে, ন্যুড লিপস্টিক লাগিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। চমৎকার লাগছে, ঠিক সেই কলেজের দিনগুলোর মতো। আত্মপ্রেমে বিহ্বল হয়ে পরে চৈতী। আবারও মনে প্রশ্ন জাগে, কার জন্য এত সাজগোজ?
ট্যাক্সিতে উঠে আকাশ দেখে চৈতি, মেঘ জমেছে। হয়তো ঝড় জল আসতে পারে! ট্যাক্সি এগোচ্ছে সমস্ত পিছুটান ফেলে। কিসের জন্য এত উৎফুল্লতা বুঝে উঠতে পারে না। হোটেলের সামনে ট্যাক্সি থেমে যায়। যত্নে রাঙানো নখের চাপে নির্দিষ্ট ঘরে কলিং বেল বাজায় চৈতী। কৌশিক দরজা খুলে হাসি মুখে সম্বোধন করেই ওকে জড়িয়ে ধরে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায়। ঘরের ভিতরে নিয়ে যায়। টাকার সঙ্গে মানুষের চেহারা আর বেশভূষার যে পরিবর্তন ঘটে, তা প্রকট ভাবে ধরা পড়ছে কৌশিকের মধ্যে। কৌশিক গ্লাসে ওয়াইন ঢালছে বোতল থেকে। কৌশিকের সঙ্গে এতটা সচ্ছন্দ হওয়াটা কি ঠিক হবে?
ঘরে গান বাজছে,
"পিপাসা হায় নাহি মিটিল, নাহি মিটিল।।
গরলরসপানে জরজরপরানে
মিনতি করি হে করজোড়ে,
জুড়াও সংসারদাহ তব প্রেমের অমৃতে।।"
কথা বলছিল ওরা। অনেক কথা। পুরনো কথা, নতুন কথা, না বলা কথা, বলা কথা.....সব। আস্তে আস্তে একটা উত্তেজনা অনুভব করছিল চৈতী। গ্লাসের অর্ধেক পানীয় শেষ করার পর স্পষ্ট বুঝতে পারছিল, গোলাপি ব্রায়ের নীচে জেগে উঠছে স্তনবৃন্তেরা। এ কী নতুন অভ্যেসের ফল? পুরুষমানুষকে শরীর ভাবছে? নারীর সহজাত দৃষ্টি দিয়ে কৌশিকের চোখের ভাষাও নজর এড়ায়নি চৈতীর।
প্রতীক্ষিত কিন্তু অপরিকল্পিত মুহূর্তটা এক সময় এসেই গেল।
কৌশিক চৈতীকে জড়িয়ে ধরল, যে ভাবে অপূর্ব তাকে ধরত। দুহাতে চৈতীকে তুলে নিয়ে কৌশিক এগিয়ে গেল বিছানার দিকে। এ ভাবে অপূর্ব কোনও দিন ওকে আদর করেনি। দীর্ঘদিন পরে ওর চৈতীর শুকনো ঠোঁটে বৃষ্টি নামাল কৌশিকের ঠোঁট..
ঠোঁট ক্রমশ নিম্নগামী। গলা ছাড়িয়ে, গোলাপি ব্রা ছুঁয়ে ফেলেছে। আরও নামছে কৌশিকের ঠোঁট। ওর অবয়ব ক্রমশ উপর নীচ করছে। একি! এ তো অপূর্ব!
চৈতী ভাল করে লক্ষ্য করে কৌশিকের অনাবৃত শরীরটা। কেন পলকে অপূর্ব মনে হল ওকে?
চৈতীর মন কেমন অপূর্ব অপূর্ব করছিল। অপূর্ব ভাল মানুষ অথচ ভাল স্বামী হতে পারল না কোনও দিন।
নিজের অজান্তেই ঝটকানি দিয়ে ফেলে দেয় কৌশিককে। তারপর বেরিয়ে ট্যাক্সি। নিউটাউন চলো।
আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ঘনঘন বিদ্যুতের আলো চোখ ঝলসে দিচ্ছে। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। এ কি বৃষ্টির শব্দ? নাকি নির্বেদ জীবনের আভোগ সঙ্গীতে বাজছে আকুল তিয়াষের শ্রদ্ধাঞ্জলি...
0 Comments
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন