প্রতিবছর এই সময়ে হাল্কা ঠান্ডা পড়লেই ক্লাস সেভেন এইটের ছেলেরা স্কুলের স্কলারশিপ অথবা মায়ের কানের গোড়ায় প্রতি ঘন্টায় ঘ্যানঘ্যান করে পাওয়া টাকা থেকে ইলেকট্রিক তার, বাল্ব, হোল্ডার কিনে রাতকে দিন করার স্বপ্ন দেখে। সাধারণত এই সময় স্কুলের শিক্ষাবর্ষ শেষ, তাই পড়াশোনার চাপ থাকেনা।

যে ছেলেটা এক সময় প্রচণ্ড দুপুরের দাবদাহ উপেক্ষা করে পিচগলা পাকা রাস্তার উপর দিয়ে নরম পায়ে, হাতে শক্ত লাঠি নিয়ে 'টায়ার' চালিয়ে অভ্যস্ত, আজ তাকে বেশ হিসেবি মনে হচ্ছে.....

'তোর কুড়ি টাকা চাঁদা, তন্ময়ের ত্রিশ, আর পটলের পঁচিশ, পিন্টুর পঞ্চাশ। রতনের মা মারা গিয়েছে। ওর কাছে কোনও টাকা নেবনা।'

তবে আজ এই অন্ধকার রাত্রে টায়ারের খোঁজ কেন? ওরা তো বেশ বড় হয়ে গিয়েছে!

 - তুই বাড়ি থেকে খড় নিয়ে আয়, আর আমি খবরের কাগজ আনছি। রাজকুমারদের বাড়ির পিছনের মাটির আলু গাছটা মরে গিয়েছে। সবাই মিলে আলু তুলে এনে আজ পুড়িয়ে খাবো।

আজ সারাটা দুপুর ওদের কোর্ট কাটতে কেটে গিয়েছে, কোথা থেকে পুরনো একটা নেট কিনে এনেছে। 'র‍্যাকেট' খেলবে।
আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ওদের চকচকে চোখে ধরা পড়ে।

অমল কাকু বাড়িতে দুর্গন্ধে আর টিকতে পারছেনা। ছেলেরা টায়ার পুড়িয়েছে। মাঠ সংলগ্ন অমল কাকুর বাড়ি, তাই জানালার কাঁচ তারই বেশি ভাঙে। আর প্রতিবার ছেলেদের এই অত্যাচার তিনি মুখ বুজে সহ্য করে যান। এক সময় তিনিও দস্যি বাচ্চা ছিলেন।  এই ছেলেদের দেখে নিজের শৈশব খুঁজে পান। তাই প্রতিবাদ, বকাঝকা কিচ্ছুটি করেন না।

ছেলেদের এই খেলাধুলা এখন প্রায় উঠেই গিয়েছে,  আগে ঝাঁঝাঁ দুপুর রৌদ্রে ছেলেদের ক্রিকেট খেলতে দেখা যেত অথবা বর্ষণমুখর বিকেলে কাদা মেখে ফুটবল।

এরাও যে এত কষ্ট করে মাঠ পরিষ্কার করে রাতে র‍্যাকেট খেলার আয়োজন করলো, তাতে এরাই খেলবে তা কিন্তু নয়! দুদিন পর দেখব সিনিয়র ছেলেরা এসে প্রত্যেক বাচ্চার হাতে মোবাইল ধরিয়ে দিয়েছে। বড়রা খেলছে র‍্যাকেট, আর বাচ্চারা 'সাবওয়ে সারফার্স' 'টেম্পল রান'।

এর পরেও আপনি বলবেন জেনারেশন এগিয়ে যাচ্ছে! সত্যিই এগিয়ে যাচ্ছে...... রকেটের গতিতে।
এর পরে আপনি যদি সেই কাঁদামাখা খালি গায়ের ছেলেটাকে ফুটবল খেলতে দেখতে চান...আপনাকে নিশ্চয় মিউজিয়ামে যেতে হবে।

জেনারেশন আমরা দ্রুততার সাথে এগিয়ে দিচ্ছি বটে, তবে তা বুলেট গতিতে। শিশুদের মধ্যে শৈশব বিপন্নের পথে, পাড়ার নারকেল চুরি, ডাব চুরি আম চুরি জাস্ট ভাবাই যায়না। আর কদিন পর দেখব শিশুরা জন্মের পরেই যৌবনে পদার্পণ করেছে, মাঝখানের স্টেপ গুলো এন্ড্রোয়েড গেমের মতো স্কিপ করা...... প্রত্যেক ক্রিয়ার একটি সমান ও বিপরীতমুখি  প্রতিক্রিয়া আছে...... নিউটনের তৃতীয় সূত্র।

Sudip Sen
8 Dec 15