ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টি পড়লে পড়তে যেতে ইচ্ছে করেনা, মনে হয় শুধু শুয়েশুয়ে রুমকির কথা ভাবি... তবু আজ অংক ক্লাস... গতবার অংকে আটত্রিশ পেয়েছিলাম, রুমকির মুখ রাগে সাঁইত্রিশের মত দেখাচ্ছিল...  আমি দুতিনবার মা কালিকে ডেকে রুমকির রাগ থামাতে বললাম...  তারপর রুমকি যখন অরিত্রর দিকে তাকিয়ে হাসলো, আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।

সময় নেই..। আমার ক্লাস নাইনের অংক বইটা আর একটা সাদা খাতা নিলাম। খাতার উপরে একটা পেত্নীর ছবি আঁকা... এই পেত্নীর সঙ্গে মনেমনে অনেক কথা বলি আমি... সোনা তুমি খেয়েছ? সোনা তুমি ঘুমিয়েছ? সোনা তোমার মুখে ব্রণ কেন? পেটের সমস্যা? জানো আমার গোঁপ বেরিয়েছে....  তারপর একান্ত আন্তরিক....।

  আমি খুব ভাল ছবি আঁকতে পারিনা, তাই যতবার রুমকিকে আঁকার চেষ্টা করি ততবার বিদঘুটে রাক্ষসী টাইপের মূর্তি তৈরি হয়... এতে আমার কোনও ক্ষেদ নেই, মানুষের মনটাই আসল....  আর.. আর এই ছবির রুমকির মনটা তো আমার নিজের হাতে তৈরি....

বাবার সাদা পাঞ্জাবিটা গলা দিয়ে গলিয়ে নিলাম। আশেপাশে ছোটকার চামড়ার চটিটা নজরে পড়ল... কিন্তু ছাতা! দাদুর ওই বাঁকানো লাঠির বাটওয়ালা ছাতাটা নিয়ে গেলে আমার কি মান- সম্মান থাকবে? বিকল্প কোনও উপায় না পেয়ে ওটাই নিতে বাধ্য হলাম।

খুব বৃষ্টি শুরু হয়েছে.. চারিদিকে ভিজে মাটির সোঁদা গন্ধ। রুমকিকে কখনও বৃষ্টিতে ভিজতে দেখিনি। রুমকি যদি কোনওদিন গাছের প্রথম গোলাপের মত বৃষ্টিতে ভিজে নুইয়ে পড়ে, আমি সমস্ত শক্তি দিয়ে ওর ঘ্রাণ নেব...

রজত বিড়ি খায়। খুব বেশি চিন্তায় পড়লে মিনিটে তিনটে বিড়ি ধরাতে দেখেছি ওকে... একদিন চিন্তামণির বাবা ওদের দুজনকে একসঙ্গে দেখে ফেলেছিল...  হাঁপাতে হাঁপাতে বটগাছের গোঁড়াতে এসেই বিড়ি ধরিয়েছে...  খুব চিন্তায় পড়লে বিড়ি খেলে তৎক্ষণাৎ বুদ্ধি আসে ওর মাথায়। আমিও সেদিন বিকেলে বুদ্ধি বাড়ানোরচেষ্টা করলাম... গভীর রাত্রে এক ভয়াল স্বপ্ন দেখে আঁতকে উঠি... রুমকি আমার উপর প্রচণ্ড রেগে গিয়েছে, পরবর্তী দু-তিনমাস আমার থেকে সাড়েচার মাইল দূরে থাকবে...  কাঁদতে কাঁদতে কখন আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছে টের পাইনি.... 

রুমকির সঙ্গে কখনও কথা বলিনি... অনেকদিন দূর থেকে দেখেছি ওকে... কখনও ওর গায়ের বাতাস আমার কাছে এসেছে... আজ...  ইচ্ছে করছে অনেক দিনের আটকে থাকা স্বপ্নগুলোকে মুক্ত করি...

ক্লাস শেষ... রুমকি তাকায়নি... একবারও না... ছাতাটা নিতেও লজ্জা লাগছে... একবার যদি সবার সামনে বলি এই বুড়ো দাদুর ছাতাটা আমার... খুব লজ্জাকর অবস্থায় পড়ে যাব... ছাতাটা না নিয়েই ফিরছিলাম...

খুব কষ্ট হচ্ছে, ভূগোলে ঊনত্রিশ পেয়ে যখন ফেল করেছিলাম তখনও এতটা দুঃখ হয়নি.. রুমকি তো একবার তাকাতে পারতো! একবার কারও দিকে তাকালে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়..?  রজতের একবার এমন কষ্ট হয়েছিল... সেদিন কোথা থেকে নেশা করে সারাদিনরাত ঘুমিয়েছিল... আজ কি নেশা করা ঠিক হবে..! তারপর যদি আবার রুমকির স্বপ্ন দেখি!

বৃষ্টি সমস্ত শরীরটাকে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে...  কষ্টে গায়ে জ্বরজ্বর ভাব এসেছে... মাতালের মত উদ্দেশহীনভাবে হেঁটে চলেছি... হঠাত পরিচিত কারও গলার আওয়াজে হুঁশ ফিরল...

- বৃষ্টিতে ভিজছ কেন? ছাতার তলে এসো... আমিও ছাতা আনতে ভুলে গেছিলাম আজ... স্যারের বাড়ি থেকে এটা নিয়ে এলাম....

খুব ইচ্ছে করছে... খুব ইচ্ছে করছে দাদুর ছাতার হাতলটাতে একবার আলতোভাবে হাত বুলিয়ে নিই....