থার্ড ইয়ারের পরীক্ষা দিয়ে ঘরে শুয়ে আছি, বেশ নিশ্চিন্তভাবে ঘুম। বয়স্ক মানুষেরা জানে, জীবনের থার্ড ইয়ার কিছুতেই কাটানো যায়না... আমারও সেই একই অবস্থা... আজ মুক্তি...  আজ আমি থার্ড ইয়ারের থেকে মুক্তি পেয়েছি......

ঘুম ভাঙছিল না, তবু বাড়িতে কেউ এসেছেন...  জোর করে ঘুম ভাঙাতেই হল। আমি চোখমুখে জলের ঝাঁপটা দিয়ে প্লাস্টিকের লাল চেয়ারটাতে বসলাম.....

 

দুপুরের এক একটা ঘুম রাতের চেয়েও গভীর হয়। ঘুমটা পুরোপুরিভাবে শেষ না করলে পৃথিবীটা চেনা যায়না, মনে হয় কেউ অযাচিতভাবে মঙ্গলগ্রহ থেকে এই ধরাধমে ছেড়ে দিয়েছে। মুখে একটা ভ্যাপসা ভাব আসে, কিচ্ছুটি আর ভাল লাগেনা.....

একজন ভদ্রলোক এসেছেন, বাচ্চার টিউশনের জন্য.... 

কলেজে পড়ার সময় নিজের পাণ্ডিত্য জাহির করতে বেশ ভাল লাগে। মনে হয় পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞান আমার মাথার ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ম্যাথ, হিস্ট্রি, জিওগ্রাফি আর ইংলিশ লিটেরেচার ফোল্ডারে সংরক্ষিত আছে, ইচ্ছেমত বার করতে পারলেই কেল্লাফতে..... কলেজ পাস করার এক বছর পর উপলব্ধি করা যায় আমার জ্ঞানের ঘটি শূন্য.....

যাইহোক, বাড়ি বয়ে যখন একজন এসেছেন তাকে কি আর না করা যায়! তাছাড়াও হাতখরচার জন্য কিছু টাকাপয়সাও প্রয়োজন....  তাই, আর না করলাম না।

পড়ানোর প্রথম দিন..... বেশ কিছুটা লজ্জিত হয়ে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করলাম। ভদ্রলোক বেশ সহযোগিতা করলেন অবস্থা অনুকূলে আনতে....

বাচ্চাটা অঙ্কতে বেশ কাঁচা। হাতে ধরা বিয়োগ ভুল করছে....  ভাগ এর অবস্থা আরও খারাপ... ১০৩ কে ১০ দিয়ে ভাগ করলে ভাগশেষ ৩ হলেও, ভাগফল যে ১ হয়না, ১০ হয়; তা বোঝাতে অনেকটা সময় কেটে গেল আমার...ঠিকঠাক বাংলা রিডিং পড়তে পারছে না, ইংরেজিতে মোটামুটি ভাল... প্রথম দিন সাড়ে তিন ঘন্টা কেটে গেল.....

দ্বিতীয় দিন.....

মোটামুটি কী শেখাব তার একটা পরিকল্পনা করে বাড়ি থেকে বেরোলাম। এতটা সময় ধরে পড়ালে বাড়ির লোকজন বিরক্ত হতে পারে, তাই একটু সময়ের দিকে নজর দিতে হবে... টেবিলে গণ্ডগোল আছে... নামতা মুখস্থ করাতে হবে... তারপর কয়েকটা গুণ... ভাগ শেখাতে হবে.... আরও বিয়োগ অনুশীলন করাতে হবে....

না... আজ আরও বেশি সময় লাগল। প্রায় পৌনে চার ঘন্টা... বাচ্চাটা অধৈর্য হয়ে পড়ছে... ছোটা ভীম, ছুটকি, রাজু ওকে হাত ইশারা করে ডাকছে.... ছুটি দিয়ে দিলাম....

রাতে ভাত খেতে বসে ভাবছি, আর কোন সহজ উপায়ে ওকে ভাগ শেখানো যায়... কাল কী কী পড়ানো যেতে পারে? পড়ানোর শেষে ওর সঙ্গে একটু  ফুটবল খেললে কেমন হয়? শিক্ষক হিসেবে একজন ছাত্রের মনের কাছে পৌঁছনো অত্যন্ত প্রয়োজন.... আমি যেমন ওকে নিয়ে ভাবছি... ওকেও আমাকে নিয়ে ভাবাতে পারলে তবেই আমি সফল... নতুবা আমি একজন ব্যর্থ শিক্ষক। পড়াশোনাতে ওর আগ্রহ বাড়াতে হবে.... 

(এই মুহূর্তে এর বেশি আর লেখার সময় নেই আমার হাতে....)

এই সমস্ত ঘটনা আমি আমার এক দুঃসম্পর্কের ভাইকে বলছিলাম....  ও আষাঢ়ে গল্প ভেবে অট্টহাসিতে লুটিয়ে পড়ল.... পৃথিবীর প্রায় প্রতেকটা মানুষকে একটা সময় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে টিউশন করতে হয়.... ও সবে থার্ড ইয়ার পাস করেছে.... তাই পড়ায়... এক ঘন্টা করে সপ্তাহে দুদিন....।

গল্পটা বলার মূলত দুটি কারণ আছে..... সময়ের থেকে সময়ের দূরত্ব এখন দ্বিগুণ গতিতে বাড়ছে, সঙ্গে বাড়ছে মানুষের থেকে মানুষের দুরত্ব.... আত্মার সাথে আত্মার.....