#চব্বিশে_সেপ্টেম্বর

‘গেট লস্ট’ বলার পর সুদীপ্তা শেষ বারের মতোও আর ফিরে তাকায়নি সৈকতের দিকে। জন্মদিনের উপহারটা ওর সামনেই ছুড়ে ফেলেছিল ড্রেনে। কালো জলরাশি ফেলে দেওয়া প্রেম বয়ে নিয়ে চলে গিয়েছিল অজানা শুষ্ক নদীর বুকে।
সুদীপ্তা প্রতি বার ফিরে তাকাত, ছাতা হাতে সে দিন হঠাৎ করে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। আর ফেরেনি।

কাউকে ভুলে যাওয়া খুব সহজ। প্রথম প্রথম মিনিটে এক বার, তার পর ঘন্টায় এক বার... এ ভাবে দিনে, মাসে বছরে এক বার, তার পর আর মনে পড়ে না। সৈকত চেষ্টা করেছিল, কিন্তু যা হওয়ার নয় তা হয়না। সুদীপ্তা সৈকতের মনের পুরনো বইয়ের নতুন মলাটের মত। একঘেয়ে জীবনের দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য নাবিক যখন জীবনের জড়তায় ধস্ত, তখনই সুদীপ্তার আগমন।

সৈকত সুদীপ্তার সাদাকালো ক্লিপের দিকে চেয়ে থাকত। তখন নিজেকে মনে হতো এক দিগ্বিজয়ী নাবিক। মনে হতো, এক নতুন মহাদেশ আবিষ্কার করেছে। আবিষ্কারের আনন্দ প্রকাশ পেত সৃজনশীলতায়, সুদীপ্তাকে নিয়ে লেখা গল্প কবিতায়। কখনও সখনও ইচ্ছে হলে জিজ্ঞেস করত, "তুমি মানুষ নাকি পরী?" সুদীপ্তা উত্তর দিত "কালপেঁচা"।

এমন প্রেমের পরাজয় আর ব্যর্থতার গ্লানিতে সৈকত কখনও গলায় ফাঁস লাগানোর কথা ভাবেনি। ভাবেনি বিষ খাওয়ার কথা, অথবা মেট্রোর সামনে ঝাঁপ দেওয়ার কথা। প্রেম এত সস্তা নয় যে চোখের জল বুক বেয়ে মাটিতে পড়বে। নীরবে একতরফা ভালবাসার মধ্যে এক অদ্ভূত মুগ্ধতা আছে। যে ভালবাসেনি সে এই উজাড় করা ভালোবাসা বোঝে না। এখানে প্রত্যাশা নেই, আছে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া। প্রেম মানে পার্কের আড়ালে কোলে মাথা রেখে বাদাম চিবোনো নয়, অথবা নির্জন গাছের ছায়ায় ঠোঁটে ঠোঁট রেখে কামনার দশ সেকেন্ড মহানন্দে কাটিয়ে দেওয়া নয়।
মানুষের ইন্দ্রিয়সুখ ও অবাধ আনন্দোপভোগ ছাড়া প্রেমের অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই এটা মনে করে নেওয়ার অর্থ ঈশ্বরদ্রোহিতা। মানবতার বিরুদ্ধাচরণ। নিঃস্বার্থ প্রেম মানুষকে মহান হতে শেখায়, মনুমেন্টের দেওয়ালের প্রতীকী আর নামের আদ্যক্ষরের মাঝে যোগ চিহ্ন বড় উৎকর্ষহীন। সুদীপ্তা এ ভাবেই শিখিয়েছিল সৈকতকে ''কর্মন্যোবধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন"।

চব্বিশে সেপ্টেম্বর। সুদীপ্তার জন্মদিন। শেষ জন্মদিনের গিফ্ট আশ্রয় নিয়েছিল সম্পর্কের শুষ্কবরফে। সে দিন থেকেই পকেটের টাকা খরচ করে রাস্তায় শুয়ে থাকা ছেলেদের মধ্যে চকলেট বিলিয়েছিল। যারা স্কুলে যেতে পারত না তাদের বই কিনে দিয়েছিল।

সৈকত সে দিন স্টেশনের ফ্রি টয়লেটের সামনে দাঁড়িয়ে ময়লা ব্লাউজের এক ভিখারিণীর ঠোঙা বানানো দেখছিল। পাশে কোলের বাচ্চাটা মুড়িতে জল মেখে খাচ্ছিল। অন্য প্ল্যাটফর্মে সুদীপ্তা দাঁড়িয়ে ছিল। ট্রেন ঢুকতে সুদীপ্তা আর ফিরে তাকায়নি, হাত দেখায়নি। সম্পর্কের শেষ সমীকরণের সমাধান হয়নি। ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে মনের সীমানার বাইরে যাত্রা করছিল। আর ট্রেনের হাওয়ায় প্ল্যাটফর্মের ধুলো উড়ে এসে পড়েছিল বাচ্চাটার মুড়ির বাটিতে।
সৈকত সেই মুহূর্তেই ভেবেছিল, সমাজটার পরিবর্তন প্রয়োজন।

—দাদা ময়নার অবস্থা আশঙ্কাজনক। ওকে হাসপাতালে ভর্তি করা দরকার। টাকা চাই।
সৈকত চেকে সই করে নীতিশের হাতে চেক ধরিয়ে দিল। পাশে প্যাডের পাতা উড়ছে, বড় বড় হরফে লেখা... "রেজারেকশন—আ নন গভর্নমেন্ট অর্গানাইজেশন।"

সে দিন সুদীপ্তার ট্রেন ছাড়ার পর, সৈকতের ট্রেন ঢোকে। তখন পড়ন্ত বিকেল। সব আলো ফুরিয়ে আসা ক্লান্ত সূর্যকেও ব্যর্থ প্রেমিক মনে হচ্ছিল। আকাশে দু’টো একটা করে তারা উঠতে লেগেছিল। ট্রেন  ছুটছে পিছনের সব বাধা ভুলে। সত্যিই কি ভোলা যায়! নাকি আমরা ভোলার ছলে কষ্ট পাই! এক বারও কি সুদীপ্তার মনে পড়বে না সৈকতের কথা! মাথা নীচু করে ঝিম হয়ে বসে ছিল সৈকত। মনের কোণে হাজারো প্রশ্ন জড় হচ্ছিল।

একটা স্টেশনে ট্রেন থামতে চেঁচামেচিতে হুঁশ ফিরেছিল সৈকতের। একটা মেয়ে জড়ো হয়ে বসে। চোখ ঢুলে পড়েছে, চোখের কোণে গভীর কালি। শুকনো বুকে খাবলের দাগ। ছেঁড়া চুড়িদারের ফাঁকফোকর দিয়ে রক্ত ঝরছে। তক্ষুণি সৈকতের ঝিমুনি কেটে গিয়েছিল। ওকে নিয়ে ছুটেছিল হাসপাতালের। পাঁচ ঘন্টা পরে একটু সুস্থ হয়েছিল সে মেয়ে, তৃপ্তি। সৈকত হাসপাতালের বিছানার পাশে বসে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, বুঝিয়েছিল পাশে আছে। বাড়ির বাবা মা আত্মীয়পরিজন কেউ আসেনি হাসপাতালে ওকে দেখতে। ও ভয় পেয়েছিল। আর এ সময়ের ভরসাটুকু অত্যন্ত দরকার ছিল ওর।

ডাক্তার বলেছিলেন, ভ্যাজাইনা স্বাবসস করতে হবে, প্রয়োজনে অ্যানাল পেনিট্রেশনও। তৃপ্তি সৈকতের হাত ধরে বারবার বলছিল ‘‘প্লিজ বলুন, সব ঠিক হয়ে যাবে’’। মেয়েটার চোখের জল দেখে কান্না পাচ্ছিল সৈকতের। সেদিন আর বাড়ি ফেরা হয়নি। খবরের কাগজের পরের দিনের হেডলাইনে সৈকতের নাম। 'সাক্ষাত মানুষরূপী ভগবান'।

কিছুটা মিডিয়া আর কিছু ভাল মানুষের সাহায্যে মেয়েদের সেক্সুয়াল অ্যাসল্ট , ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স আর ইনসেস্ট এর বিরূদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে, তাদের সহযোগিতায় এবং পরিচর্যায় শুরু করে ‘‘রেজারেকশন— আ ননগভর্নমেন্ট অর্গানাইজেশন’’। তৃপ্তি ওকে বিভিন্ন কাজে সাহায্য করে। তৃপ্তি নিজের জীবনে প্রত্যক্ষ করেছে মেয়েদের সমস্যা কোথায়। সৈকতের ঋণ ও ভোলে কী করে? সৈকত ওকে জীবন দিয়েছে। সৈকতকে দাদা বলে ডাকে তৃপ্তি।

পুরনো স্মৃতিতে বড্ড জড়ায় আজকাল সৈকত। এক্ষুণি ময়নার খোঁজ নেওয়া দরকার। ময়নাদের এলাকায় আরও কাজের জন্য আজ এক বার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের বাড়িতে যেতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পরে সৈকত। জ্যামে দাঁড়িয়ে কাচের বাইরে চোখ যায়, একটা ছেলে গাছের আড়ালে একটা মেয়েকে রঙিন কাগজে মোড়া কিছু উপহার দিচ্ছে। মেয়েটা অত্যন্ত রেগে 'গেট লস্ট' বলে ছুড়ে ফেলে দিল নর্দমায়। ঘটনাটা কেমন যেন চেনা মনে হল সৈকতের। মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ যায়। আজ চব্বিশে সেপ্টেম্বর। কিছুতেই মনে করতে পারে না, কোন সিনেমায় দেখেছে এই দৃশ্য!

তবু চব্বিশে সেপ্টেম্বর! চব্বিশে সেপ্টেম্বর! ভাবতে ভাবতে গন্তব্যে পৌঁছয় সৈকত। খবর নিয়েছে, ময়না ভাল আছে। চিকিৎসা চলছে। ডিএম-এর ঘরের বাইরে বসে পরের কাজকর্ম নিয়ে ভাবছিল সৈকত। সম্বিত ফিরল, ‘‘ম্যাডাম ডাকছেন।’’

দরজা ঠেলে ঢুকে এই দৃশ্যটাই দেখা বাকি ছিল বোধ হয় সৈকতের। টেবিলের ও-পারে সুদীপ্তা! পাটভাঙা তাঁতের শাড়িতে দেবী সরস্বতীর মতো দেখাচ্ছে ওকে। চোখে মুখে পরিণত বয়সের দ্যুতি। উজ্জ্বল চোখদু’টো তুলে সৈকতের দিকে তাকাতেই সৈকত সম্বোধন করল, —ম্যাডাম... বলতে লাগল, আমি সৈকত বসু, রেজারেকশন সংস্থা নিয়ে কাজ করছি... আপনার কাছে কিছু কথা নিয়ে এসেছি.....

সুদীপ্তার কোনও প্রতিক্রিয়া দেখতে চায় না সৈকত। নিজের কথা বলে চলে। ঘরের পর্দাটার ও-পার থেকে বছর সাতেকের একটা মেয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে আসে সুদীপ্তার কাছে। — মা হোমওয়ার্ক হয়ে গিয়েছে। খেলতে যাই?

সৈকত ভাবতে থাকে, সে দিনের অগোছালো রাগ অভিমানগুলো আজ পরিণতি পেয়েছে। দু পক্ষেই। এক পক্ষ এক দিকে সুখী মা, অন্য দিকে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী। অন্য পক্ষ মানুষের মাঝে বিলিয়েছে নিজেকে। খুঁজে পেয়েছে জীবনের মানে।

না এ সব ভাববে না সৈকত। এ বার ময়নার কাছে যাবে। তার পর আরও অনেক অনেক অপেক্ষা করে থাকা ময়নাদের হাতে জীবন নামের উপহার তুলে দেবে... সে উপহার কোনও দিন নর্দমায় ভাসবে না...