#হ্যালুসিনেশন

সম্রাট রেল লাইনের ওপর বসে আছে,পা দিয়ে পাথর ঠেলছে। ওর অবস্থাও এই পড়ে থাকা পাথরের মত, কোন দাম নেই। পাথরটাতে সজোরে লাথি মারে,গড়গড় করে নীচে গড়িয়ে যায়।
আর সাঁইত্রিশ  মিনিট সাতান্ন সেকেন্ড পর ট্রেন আসবে,আর ওকে পিসে দেবে। রক্ত ছিটকে লাগবে সেই পাথরে,শেষবারের মত হাত টা মুঠো করবে, তারপর কুকুরে তার হাত নিয়ে মহাভোজ করবে। আচ্ছা মৃত্যুর সময় কি কষ্ট হয়? যন্ত্রণা হয়? না কি জীবনের সব যন্ত্রণা মৃত্যুর আগে পর্যন্ত?
শৈশবের অভিকর্ষজ টান ওকে মৃত্যুর থেকে দুরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। শৈশব থেকে ক্লান্ত যৌবন সব স্মৃতি ভেসে উঠছে।বাবার পিঠে চড়ে  ঘোড়া ঘোড়া খেলা,একটু বয়স হলে গঙ্গারধারের কাশফুলে লুকোচুরি। যখন সবাই ধর্মের ভীরুতায় গঙ্গায় প্রণাম করে খুচরো পয়সা ছুরে ফেলতো,ভাই এর সাথে চুম্বক নিয়ে জলের তল থেকে সেই পয়সা বের করে সোনপাপড়ি কিনে খেত।ধীরে ধীরে বড় হল আর বাড়তে থাকলো ভূগোলের পরিধি। ধানশিড়ি থেকে সিঁড়িভাঙা অঙ্ক। জীবনানন্দ দাশ পড়তে পড়তে অজান্তে বনলতা সেনের প্রতি ভালবাসা জাগতে থাকে। তখন কবিতা লিখতো। আর বনলতা সেন কবিতার পাতা ভাঁজ করে উড়োজাহাজ বানিয়ে তা আকাশে উড়াতো। শিউলি যেমন তার পাঁচটা স্তবক নিয়ে মুখ থুবরে পড়ে,তার ঊর্ধ্বাঙ্গ থাকে আকাশের পানে চেয়ে।
তেমন ই সম্রাটের আবেগ ঘুড়ি হয়ে আকাশে উড়তো,আবার ভোকাট্টা হয়ে অবিলম্বে  নীচে পড়ে যেত। জরাজীর্ণ হৃদয় কাগজের উড়োজাহাজের মত ঠুকরে পড়তো। ভালোবাসা এমন ই কাঙাল করে মানুষকে, দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য করে তোলে।বাস্তবতার এক এ চন্দ্র, দু এ পক্ষ ভুলে যায়,কিছু ভালবাসা একপাক্ষিক।সেখানে কোন প্রত্যাশা নেই,আছে নিজেকে সম্পুর্ণ ভাবে বিলিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার। সম্রাট বিছানাতে শুয়ে ডিঙি চড়ে পারি দিত স্বপ্নের রাজ্যে।বনলতার কোলে মাথা রেখে চাঁদের মৃদু স্নিগ্ধতায় ওদের প্রেম পূর্ণতা পেত। স্বপ্ন ভাঙলে চোখ আকাশে যেত। স্বপ্নের ডিঙি ফিরে আসতো বাস্তবে এক কলঙ্কিত স্বপ্নদোষে। সব ভেঙে ছারখার হয়ে যেত। কাতরে কাতরে বলতো "বনলতা,আমাই বিষ দাও,আমি তোমার হাতে মরতে চাই"। বনলতা চোখে কাজল লাগায়,সামনের চুল পেছনে নিয়ে বাধে,'নিঃসঙ্গ সম্রাটের ' নিঃসঙ্গতা বেড়ে যায়।
আর উনিশ মিনিট বার সেকেন্ড পর সম্রাটের বুকের উপর দিয়ে ট্রেন যাবে,ওর মাথা থেঁতলে পড়বে কোন এক বনলতার উপর,হৃদয়ের রক্ত ফিনকি দিয়ে বেয়ে পড়বে কোন এক পাথরের পাশে বেড়ে ওঠা বনফুলের পাপড়িতে,আর সম্রাট এখন ও জানেনা...বনলতা ভালবাসতো কি না!
সম্রাটের ভালোবাসা ছিল অনেকটা রাস্তার ধারে বেড়ে ওঠা ভাঁটফুলের মত,আপনা থেকেই বড় হয়,ফুল ফোটে। হঠাৎ সেই ফুল কোন গাড়ির চাকায় পড়ে প্রাণ হারায়।প্রেম নীরবে আসে আর নীরবে মারা যায়।কেও জানতেও পারেনা।
অদূরস্থ ট্রেনের ঝিঁকঝিঁক আওয়াজ শোনা যাচ্ছে,সাথে বাঁশির শব্দ। বাঁশি!  নাকি মৃত্যুর ঘন্টাধ্বনি?আর পারছেনা সম্রাট। দৈত্যাকার ট্রেন ছুটে আসছে গোগ্রাসে তাকে গলাধঃকরণ করতে।মৃত্যুকে ভয় পেলে চলবেনা।সম্রাট সাহস আনে বুকে,সেতো প্রকৃত অর্থে সম্রাট।
টানটান হয়ে দুলাইনের মাঝে শুয়ে পড়ে। রেললাইন টা আজ বালিশ,অথবা বনলতার খালি কোল,মাথা রেখে চিরনিদ্রায় যেতে চায় রূপকথার রাজ্যে।যেখানে বনলতা নেই,আছে বনলতাকে নিয়ে একপাক্ষিক ভালবাসার ভাবনা।
ঐ তো..ঐ...আর মাত্র পাঁচ মিনিট নয় সেকেন্ডের   দুরত্ব.. আহ! মৃত্যুকে কাছে থেকে দেখার কি শান্তি! এইতো লোহার চাকা..আয়! আয়! আমাকে পিষে দিয়ে যা।এইতো,বসন্তের শেষ ঘন্টাধ্বনি।বিদায় ধরণি।বিদায় বনলতা।

মৃত্যুর পর সম্রাটের শরীরটা পরে থাকবে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে।শেয়াল কুকুর ছিড়ে ছিড়ে খাবে।তারপর রেল কর্তৃপক্ষ আর লোকাল থানার বিবাদ হবে। বডি আসলে কার? কার দায়িত্ব মৃত শরীর ভস্মীকরণ অথবা পোস্টমর্টেম? এই নিয়ে বেলা গড়াবে, শরীর থেকে দুর্গন্ধ বেড়োবে..লোকে রুমাল দিয়ে পাশ দিয়ে যাবে, আর গালি দেবে....শালা শুয়োরের বাচ্চা...মরার আর জাগা পেলোনা?
আচ্ছা! মৃত্যুর পরেও কি লোকের গালি খেতে হয়?

ট্রেনের আওয়াজ রেলের লাইনে ভেসে আসছে, সম্রাট কান পেতে শুনছে। এভাবেই অনেকবার কান পেতে শোনার চেষ্টা করেছে,বনলতা বলেনি, 'তোমাই ভালবাসি'...আজ শেষবার মৃত্যুর আগে যদি ছুটে আসতো! বুকে জড়িয়ে ধরে বলতো...

না...আর ভাবতে পারছেনা সম্রাট...মৃত্যু চাই..মৃত্যু..
মৃত্যুতেই জীবনের পরিসমাপ্তি। এই তো..অন্তিম ভাবনাতে এসেছে বনলতা..এই ওর ঠোঁট..এই বুক..এই ওর ঘণ চুল...রেলের লাইন আলতো করে চুমে নেয়। পাথর দিয়ে বারবার মাথায় আঘাত করে...মাথার রক্ত চোখের জলের সাথে মিশে টপটপ করে ঝড়ে পরে বুকের বাঁপাশ দিয়ে,তারপর গড়িয়ে পরে রেলের লাইনে...এই তো বনলতার ঠোঁট...ভালোবাসার রক্ত চুম্বন। যন্ত্রণায় ছটপট করে।

ঐ তো...মৃত্যুদূত এসে গেছে...সম্রাট লোহার পাতে  মাথা রেখে ডাকছে...বনলতা..ব..ন...ল..অ..তা...আ....

পাশ থেকে কোমল হাত সম্রাটের কপাল স্পর্শ করলো,ভ্রুর ওপরের চুল স্বজত্নে সাপটে সামনের দিকে টানলো। কপালে আলতো চুম্বন করে,কানের কাছে মুখটা এগিয়ে ফিস্ ফিস্ করে বললো...মৃত্যুর পরেও আমায় শান্তি দেবেনা? এবার তো আমায় নিয়ে এলোমেলো ভাবনা ছারো!
অনেক হয়েছে পাগলামি, এবার আমায় মুক্তি দাও।