শান্ত ছেলেরা যে দুষ্টুমি করবেনা এমন কোনও বিধিনিষেধ পুরাণে লেখা নেই।

আমার ক্লাস সেভেন এইট আর নাইন ঋক্‌বৈদিক যুগের মত গুরুগৃহে বিদ্যাচর্চা করে কেটেছে। সারাদিন স্যারের বাড়িতে পড়াশোনা করতাম, একমাত্র বিকেলবেলাতে হাতে হ্যারিকেন নিয়ে বাড়ি ফিরতাম, কারণ কাঁচের কালি মোছা আমার দ্বারা সম্ভব ছিলনা। তখন বিদ্যুৎ বিভ্রাট নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।

হসপিটালের কোয়াটারে স্যার থাকতেন, একই কোয়াটারে থাকতেন টুম্পা দি। টুম্পা দি আমাদের হাসপাতালের নার্স ছিলেন। অসময়ে কোনও প্রেগন্যান্ট রুগী এলে আগে আমাদের জানালাতে টোকা মারত, আমরা টুম্পাদিকে ডেকে দিতাম।

টুম্পাদির ঘরে জানালার ধারে আপেল, কলা, বেদানা, বিস্কিট, ক্যাডবেরি, চকলেট একে একে সাজানো থাকতো। মাঝেমধ্যে মনে হতো মা অন্নপূর্ণা পসার সাজিয়ে রেখেছেন আমাদের জন্য।

গরমকালে পরীক্ষা দিয়ে আমরা ফিরতাম কাঁচা আম চিবোতে চিবোতে। ও হ্যাঁ, আমার সাথে আমার এক বন্ধু থাকতো, সে সব কাজে বাহাদুর, বুদ্ধিতেও।

ইচ্ছে হলেই আমরা হাত বাড়িয়ে আপেল, কমলালেবু, ন্যাসপাতি ইচ্ছে মত তুলে নিতাম। এত সব আমাদের জন্যেই রাখা! টুম্পাদি ভাবতো হয় তার মেয়ে ঝুমকি খেয়েছে অথবা কাজের মেয়ে টেঁপি।

একদিন মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে ফিরছি। জানালার পাশে আপেল, আঙুর, বেদানা কিচ্ছু নেই! যাহ্‌! কী হবে এবার! পাশে রাখা ছিল আমূল দুধের কৌটা। ছিঃ! উচিত হবে!

সাতপাঁচ ভাবিনি। টুম্পা দিও আমাদের দিয়ে অনেক কিছু করাতো, দোকান থেকে পাঁচফোড়ন এনে দেওয়া, মেয়ের জন্য স্রেলাক অথবা সাতসকালে কাটমাছ।
তুলে নিলাম।

কিন্তু নেব কিভাবে? নিয়ে রাখবো কোথায়? একদিনে এত আমূল দুধ কিছুতেই খাওয়া যাবেনা।

পাশে পড়েছিল পুরনো স্কুল ব্যাগ। ওটাতে ভরে সটান চলে গেলাম আম বাগান। আম বাগানেরও একটা নাম ছিল 'অখিল সাহার আমবাগান'।

দুজন মিলে কাশতে কাশতে গলায় লাগিয়ে বেশ কিছুটা আমূল দুধ খাওয়ার পর ভাবলাম এবার এটাকে কোথাও রাখার একটা পাকাপাকি ব্যবস্থা করতে হবে।
বন্ধু গাছের শিবডগালের একটা ডালে আমূল দুধের ব্যাগ কশে দড়ি দিয়ে বেধে রাখল।

পরের একটা সপ্তাহ আমরা হাসপাতালের কোয়াটারে ল্যাট্রিন যাওয়ার পরিবর্তে গিয়েছিলাম অখিল সাহার আমবাগানে। কারণ সেখানে ব্রেকফাস্ট এর ব্যবস্থা ছিল। আর আমরা আমূল দুধের ব্যাগটার স্থান রেগুলার আপডেট করতাম, পাছে পাসওয়ার্ড হ্যাক হওয়ার ভয় ছিল।

তারপর একদিন টুম্পাদির ট্রান্সফার হয়ে গেল। টুম্পাদির সমস্ত মালপত্র আমরা সানন্দে গাড়িতে তুলে দিচ্ছিলাম, সেদিন ছিল বিজয় দশমী।
কোথাও যেন গান বাজছিল

'আশা ছিল, ভালবাসা ছিল............'

একেক দিন রাত্রে আমরা বাড়ি ফিরতাম। বিশেষ করে যেদিন বাড়িতে আত্মীয়দের আগমন ঘটতো।
শীতের রাত্রে কাউকে ডিস্টার্ব করার কোনও উদ্দেশ্য আমাদের ছিল না। তাসত্ত্বেও 'কর্মকার' বাড়িতে লাগানো নতুন কলিং বেল গুলো একবার  না টিপলে যেন রাত্রে ঘুম হবেনা!

একদিন কলিং বেল টিপেছি, তৎক্ষণাৎ দরজা খুলে গিয়েছে...... হাত দুটো দুদিকে বার করে বলেছিলাম......

আহ্! কী সুন্দর রঙ!

কর্মকার বাড়ির লোকজন বোধহয় খুবই মহৎ, হাতেনাতে চোর ধরতে পেরেও আমাদের সেদিন মারেনি।

বিকেলে যখন ঢং ঢং করে হাতে হ্যারিকেন নিয়ে ফিরতাম, কর্মকারদের পরস্পর সন্নিহিত চারটে  দোকানের মধ্যে প্রথম দোকানের  মালিক বোতলটা এগিয়ে দিয়ে বলতো......

" বাবা, ঘোষেদের কল থেকে এক বোতল জল এনে দিবি?"

আচ্ছা, মাসের ত্রিশটা দিন জল এনে দিতে ভাল লাগে! স্যার বিড়ি কিনতে দিলেই রেগে যেতাম, আর লোকের জল।

একদিন ঘোষেদের কলের পাশে আড়াল করে প্যান্টের চেইনটা খুলেছি বোতলে জল ভরবো বলে...তারপর ভাবলাম, না! বড় পাপ হয়ে যাবে।
বরং হাসপাতালের পুকুরের পানাসমেত জল ভরে দিই, বুঝতে পারলে, আর কোনওদিন বলবেনা।
সত্যিই, লোকটার মাথাই বুদ্ধি ছিল।

এই ছিল কুবুদ্ধির কিছু নিদর্শন, যদিও আমি অত্যন্ত সাধারণ সাদামাটা টাইপের বোকা এবং সরল ছেলে।

কিন্তু, ওইদিন গুলি যে জীবনের গোল্ডেন ডেইস ছিল, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

10 Dec 15