তাল পাতার সেপাই

রাত দুটোর দিকে শুধাংশুর ঘুম ভেঙে গেলো।বাইরে কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ  করে ডাকছে।কিছুতেই চুপ করছে না।টর্চটা হাতে নিয়ে কাঠের দর্জাটা খুলে বাইরে বেড়োলো।একটু চেঁচামেচি করে যখন কুকুরগুলো ভেগে পড়লো ও আবার ঘরে ফিরে এল।কাচের বোতল থেকে একটা গ্লাসে কিছুটা জল ঢেলে শেষ বিন্দু পর্যন্ত পান করলো।
স্বভাবের ধীরস্থির শুধাংশু আজ যেন অতিমাত্রায় হিমায়িত হয়েছে।

সেই ২০০৭ সালে বাকুড়ার বিষ্ণুপুর থেকে শুধাংশুর যাদবপুরে আগমন।আজ আট বছর পার হয়ে যাবার পর ও শুধুমাত্র কিছু বাচ্চা পড়িয়ে ওর মোটামুটি ভাবে দিন কেটে যায়।কলেজে পড়া ইতিহাস বোধহয় ও ভুলে গেছে কিন্ত চোখের সামনে দেখা বাস্তবের উপর ওর রিসার্চকে ও হয়তো কোনোদিন ই ভুলতে পারবে না।আর এই গভীর রাত্রে ওর মনে পড়ে যাচ্ছে এখানে আসার প্রথম দিনের দিনগুলো।কত কষ্টটাই না ওকে করতে হয়েছে।প্রথমে ডেলিভারির কাজ,বাড়ি বাড়ি দুধ দেওয়া,বাচ্চা ছেলেগুলোকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া,বাজার করে দেওয়া।অহংবাদীতার দৈত্য ওকে কখনো গ্রাস করতে পারেনি;ও জানতো বাঁচতে গেলে সংগ্রাম করতেই হবে।সপ্তাহের তিনদিন ডাল আর তিনদিন আলুপটলের রসা খেয়েই চলতো।আর রবিবারে চুনুমাছের চচ্চড়ি। রবিবারে ওর বড্ড মায়ের কথা মনে পড়তো।কিন্তু ও জানতো ফেরার কোন রাস্তা নেই,আর ফিরেই বা যাবে কার কাছে?

কিছুতেই ঘুম আসছেনা আর।অতীত আর্ততা ওকে আজ যেন প্রকট ভাবে জড়িয়ে ধরেছে।কিন্তু ওকে তো ঘুমোতেই হবে।রাতের শেষে নতুন সূর্য ওর জন্য নতুন দিনের বার্তা বয়ে আনতে চলেছে,কাল মিস্টার রায়চৌধুরি ওকে ইন্টার্ভিউতে ডেকেছে।

ভাঙা জানালা দিয়ে যখন সূর্যের ছটা ওর মুখের উপর পড়লো,আচমকাই ঘুম ভেঙে গেল।তড়িঘড়ি করে পাশে রাখা মোবাইলের ডিসপ্লেতে চোখ রাখে,সাত'টা কুড়ি। আর বসে থাকা চলেনা,শীগগির ফ্রেশ হয়ে নিতে হবে।শুধাংশু ব্রাশ এ পেস্ট লাগিয়ে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল।

এত সকালে রান্নার মাসি আসেনা।কাকুর দোকান থেকে একটু চা খেয়ে দুটো কেক ব্যাগ এ পুরে নিয়ে বাসস্ট্যান্ড এর উদ্দেশ্যে এগিয়ে গেল।পকেটটা একটু হাতিয়ে নেয়, না কোন বিড়ি নেই।

রাস্তাই হাঁটতে হাঁটতে শুধাংশু অনুধাবন করতে থাকে চাকরিটা পাওয়ার প্রয়োজনীয়তা।কিছু সময় মানুষ বাস্তবিকতাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাই।ডাল ভাত খেয়ে হয়তো বেচে থাকা যায়,কিন্তু জীবন চলে কি?

শহজ করে ভাবাটা শুধাংশুর স্বভাব,আর সাত-পাঁচ ভাবেনা।টিউশনি করে তো ওর দিব্যি চলে যাচ্ছে, অন্তত ডেলিভারি আর ফাইফরমাশ খাটার থেকে অনেক সম্মানজনক। অন্তত আত্মসন্তুষ্টি আছে।শুধাংশু আর আশা' করতে চাইনা।কারণ বেশীরভাগ আশা ই ওর জীবনে অপুর্ণতাতে পরিণত হয়।

বাসস্ট্যান্ড এ পৌঁছে নিউটাউন গামী একটা বাস ধরে নেই।একেই তো গরম তার উপর ট্রাফিক জ্যাম। বাসের মধ্যে প্রায় সিদ্ধ হবার উপক্রম।প্রায় দেড় ঘন্টার মাথায় বাস নিউটাউন এসে দাঁড়ালো।
অফিসের সামনে দাড়িয়ে ঠিকানাটা মিলিয়ে নেই DH-1,Block No-DH, Action Area-1, New Town, Kolkata - 70015।টিপিটিপি পায়ে অফিসের ভীতরে প্রবেশ করে।

অফিসের কৃত্রিমতা ওর একদমই পছন্দের নয়।বিশেষ করে রিসেপশনের সুন্দরি মেয়েদের ওর কেমন একটা বিরক্তিকর লাগে।ওয়াশরুমে গিয়ে মুখটা ধুয়ে নেই,চুলটা ঠিক করে।তারপর আর কয়েকজন প্রার্থীদের মত ও নির্দিষ্ট স্থানে বসে 'শুধাংশু রায়'বলে ডাক শোনার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।

যথা সময়ে ওর ডাক আসে,ইন্টার্ভিউ দেওয়ার জন্য কক্ষে প্রবেশ করে।

ফাইনালি কত্তৃপক্ষ জানান মাত্র একজনকেই তারা নির্দিষ্ট পদের জন্য মনোনীত করতে পারবেন।তারা দুজনের নাম প্রকাশ করলো,অমৃতা গুপ্তা ও শুধাংশু রায়।শুধাংশুর মুখে হাঁসির রেখা ফুঠে উঠলো।পাশে বসে থাকা একজন মধ্যবয়সী মহিলা সামনের দিকে এগিয়ে এল।উনিই বোধহয় অমৃতা গুপ্তা।

মহিলাটি শুধাংশুর দিকে এগিয়ে এল,আর শুধাংশুর কাছে জানতে চাইলো  তার নাম-ই শুধাংশু রায় কিনা!
শুধাংশু সম্মতি জানাল।এরপর উনি জানালেন যে শুধাংশুর সাথে তার কিছু কথা আছে আর একটু নিরিবিলিতে যাওয়ার অনুরোধ করলেন।

শুধাংশু অফিস থেকে বেড়িয়ে বড় অশ্বত্থ গাছের নীচে অপেক্ষা করতে থাকলো।

দশ মিনিটের মধ্যে অমৃতা দেবী শুধাংশুর কাছে উপস্থিত হলেন।তিনি বলতে শুরু করলেন:

"দেখুন শুধাংশু বাবু আমি জানি আপনার চাকরি টা খুব দরকার আর আমারো।তিন মাস আগে দুর্ঘটনাতে আমার স্বামী মারা গেছেন;সহাই সম্বলহীন আমার পাঁচ বছরের একটি মেয়ে ছারা আর কেও নেই।স্বামী মারা যাবার পর শশুর বাড়ির লোকে আমাই অস্বীকার করে।আর আমার মনে হয় যখন ভালোবাসার শেষ হয় তখন লিগালি কোন আইনি জটিলতা নতুন করে ভালোবাসা আর শ্রদ্ধাবোধ মানুষের মধ্যে জাগাতে পারেনা।এখন আমি বৃদ্ধ বাবা আর এই শিশু কন্যাকে নিয়ে বিড়াটিতে একটি ছোট্ট বাড়িতে ভাড়া থাকি।এই চাকরিটা না পেলে আমার বেচে থাকার শেষ রসদ টুকুও বোধহয় শেষ হয়ে যাবে,শুধাংশুবাবু আমি একটু বাচতে চাই।"

কিছুটা সময়ের জন্য শুধাংশু হতভম্ব হয়ে পরে।কি করবে বুঝে উঠতে পারেনা।সত্যিইতো এই চাকরিটা না পেলে ও হয়তো টিউশনি করে চালিয়ে দিতে পারবে কিন্তু অমৃতা দেবী আর তার কন্যা সন্তান! তাদের কি হবে?

আর একমিনিটও দাড়িয়ে থাকার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনা শুধাংশু। ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে ছুটতে থাকে, ছুটতেই থাকে।এই দৌড়ের বোধহয় কোন শেষ নেই।